অন্যান্য

উৎক্ষেপণকেন্দ্র 39A, কেনেডি স্পেস সেন্টার, কেপ ক্যানাভেরাল

দশ মে, দু হাজার আঠার। সকাল সোয়া এগারোটা।

কেপ ক্যানাভেরালে spaceX এর হ্যাঙ্গার

যখন লেখাটা শুরু করছি তখন ঢাকার আকাশ কালো করে এসেছে কালবৈশাখির ঝড়। বৃহস্পতিবার। কাল থেকে দুদিনের ছুটি। তাই প্রকৃতির এই ধুন্ধুমার পরিস্থিতিতেও ঢাকায় ব্যস্ততার কমতি নেই। ঢাকা থেকে ১৪ হাজার দুশ কিলোমিটার দুরে পৃথিবীর আরেক প্রান্ত কেপ ক্যানাভেরালে চলছে রাত। ওয়েবের তথ্য অনুযায়ী সেখানে আকাশ হালকা মেঘাচ্ছন্ন। কেপ ক্যানাভেরাল ফ্লোরিডার মেরিট আইল্যান্ডে। একপাশে কেপ ক্যানাভেরাল এয়ারফোর্স স্টেশন রেখে পাশেই জন এফ কেনেডি স্পেস সেন্টার (KSC)। কিছু দুরে দুরে পাতানো চারটে  লঞ্চ সাইট, কেবল দুটো সচল- A এবং B। Launch pad 39A তে স্পেস-এক্সের শ’খানেক প্রকৌশলী-টেকনিশিয়ান তাদের পরবর্তী দিনের রকেট উৎক্ষেপণের শিডিউল মেইনটেইনের জন্য সব  প্রস্তুতি সেরে নিয়েছেন। উৎক্ষেপণের আগে আর ঘন্টা পনের বাকি। এখন চলছে কিছু শেষ মুহুর্তের ইন্সপেকশন, বসের অফিসে কয়েকটা ফাইনাল মিটিং। এক একটা উৎক্ষেপণে প্রায় পঞ্চাশ-ষাট মিলিয়ন ডলারের কন্ট্রাক্ট। সাথে জড়িয়ে আছে কোম্পানীর সুনাম, নিরাপত্তা ইস্যু। সুতরাং সবকিছু ঠিক হওয়া চাই।

 

জুলাই ষোল, ১৯৬৯। বাংলাদেশ সময় বিকাল পৌনে পাঁচটা।
কেনেডি স্পেস সেন্টারের ঘড়িতে সকাল ছটা বেজে পয়তাল্লিশ মিনিট। আকাশ পরিষ্কার ফকফকা। KSC লঞ্চপ্যাড 39A তে সোজা দাঁড়িয়ে আছে প্রায় ছত্রিশ তলার সমান উঁচু এক মহাকাশ যান। সকালের নাস্তা সেরে এসে তিনজন যাত্রী প্রবেশ করল সেই যানে। পাঁচ …চার…তিন…দুই…এক। দিগবিদিক ধোঁয়া ছড়িয়ে উড়ে গেল Saturn V। গন্তব্য চন্দ্রবিজয়। পঁচাত্তর ঘন্টা ছাপ্পান্ন মিনিটের যাত্রা শেষে চলে এল সেই ক্ষণ। সাড়ে চার বিলিয়ন বছর আগে পৃথিবী থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া এক জনহীন দ্বীপে পা রাখল দু-লক্ষ বছর আগে বানরের একটি শাখা প্রজাতি থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়া, আত্নচেতনবোধসম্পন্ন এক প্রাণসত্তা।

শুধু উপাখ্যানসম অ্যাপলো-১১ অভিযান নয়, এর আগে-পরেও লঞ্চপ্যাড 39A সাক্ষী হয়েছে অসংখ্য ইতিহাসের। ১৯৬৭ সালের

চাঁদ থেকে তোলা পৃথিবীর প্রথম ছবি, অ্যাপোলো ৮

৯ নভেম্বর Apollo-4 দিয়ে যাত্রা শুরু হয় স্যাটার্ন-৫ রকেট উৎক্ষেপণের জন্য বিশেষভাবে নির্মিত এই স্থাপনাটির। এর একবছর বাদেই ২৪ ডিসেম্বর ১৯৬৮ তে অ্যাপলো ৮ অভিযান শুরু হয় এখান থেকেই, যেটি ছিল পৃথিবীর কক্ষপথের বাইরে মানুষের প্রথম পরিভ্রমণ। চাঁদের চারপাশে প্রদক্ষিণ করে প্রথমবারের মত চাঁদের অন্যপাশ পর্যবেক্ষণ কিংবা চাঁদের আকাশ থেকে পৃথিবীর অবয়ব পরিলক্ষণ, সবটাই ছিল এক এক নতুন ইতিহাস। স্যাটার্ন-৫ এর শেষ মিশনে আমেরিকার প্রথম স্পেস-স্টেশন পে-লোড হিসাবে উৎক্ষেপিত হয় এখান থেকেই।

এর পর আসে স্পেস-শাটলের যুগ। স্পেস শাটল হল NASAর তৈরি স্পেসক্রাফট যেটার অংশবিশেষ একাধিকবার ব্যবহার করা যেত। NASA একটা প্রোটোটাইপসহ মোট ছয়টা স্পেস শাটল তৈরি করেছিল- কলম্বিয়া, চ্যালেঞ্জার,  আটলান্টিস, ডিসকভারি, এনডেভর এবং এন্টারপ্রাইজ (প্রোটোটাইপ স্পেসক্রাফট)। শাটল প্রোগ্রামের প্রথম রিউইজড ফ্লাইট (১৯৮১) এবং শেষ ফ্লাইট সহ  (২০১১) মোট ৮২ বার শাটল উৎক্ষেপণ সম্পন্ন হয় Pad-39A থেকে। এর মধ্যে ছিল আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশনের নির্মান সহযোগিতা থেকে শুরু করে অসংখ্য স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণ এবং মানব অভিযাত্রী পরিবহন। মহাকাশ যাত্রার ইতিহাসের সবচেয়ে দুঃখজনক ঘটনাগুলির একটি হল ফেব্রুয়ারি ১, ২০০৩ এর কলম্বিয়া শাটল দুর্ঘটনা, যেটি পরিচালিত হয়েছিল এখান থেকেই। কলাম্বিয়া স্পেস শাটলের ২৮তম উৎক্ষেপণের সময় এর জ্বালানী ট্যাংকের তাপরোধি ফোমের একটা অংশ ছিঁড়ে যায় এবং পাখায় আঘাত করে। পৃথিবীর বায়ুমন্ডলে পুনঃপ্রবেশের সময় এই ক্ষতিগ্রস্ত পাখা বায়ুমন্ডলের ঘর্ষনে তৈরি প্রচন্ড তাপ সহ্য করতে পারে নি। ফলশ্রুতিতে স্পেসক্রাফট ফেইল করে এবং এই মিশনে সাতজন মহাকাশচারী নিহত হন।

২০১১ সালে শাটল যুগ শেষ হওয়ার পর বেশ জোরেসোরে শুরু হল মহাকাশযাত্রার বাণিজ্যিকীকরণ। NASAর বিভিন্ন মিশনের কন্ট্রাক্ট কেনার সুযোগ থাকায় বেশ কয়েকটা কোম্পানির ভেতর প্রতিযোগিতা তৈরি হল। এরই মধ্যে ২০১৪ সালে ২০ বছরের জন্য লঞ্চপ্যাড 39A ভাড়া নিল SpaceX। উদ্দেশ্য হল Falcon 9 এবং Falcon Heavy এর উৎক্ষেপণগুলি পরিচালনা করা। Falcon Heavy দিয়ে উদবোধনের পরিকল্পনা থাকলেও ২০১৬ সালের সেপ্টেম্বরের AMOS-6 স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণের সময় বিদ্ধস্ত হলে Falcon Heavy এর প্রোগ্রাম বিলম্বিত হয় এ বছরের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত। এর মাঝে SpaceX ২০১৭ সালেই pad-39A থেকে ১৩ টি এর সফল উৎক্ষেপণ চালায় Falcon 9 এর। সর্বশেষ এ বছরের ৬ ফেব্রুয়ারি Falcon Heavy উৎক্ষেপণ দিয়ে আরেকটি ল্যান্ডমার্ক স্থাপন করে সাইটটি।

লেখার এটুকু পর্যন্ত পৌছাতে কেটে গেছে কয়েক ঘন্টা। বাংলাদেশের আকাশে সন্ধ্যা নেমে এসেছে। কেপ ক্যানাভ্যারালে এখন সকাল। আর মাত্র ঘন্টা আটেক পর pad-39A ইতিহাসের ১০৮ তম উৎক্ষেপণে সঙ্গী হবে বাংলাদেশ, স্যাটেলাইট বঙ্গবন্ধু-১। যদিও এই উৎক্ষেপনের পেছনে সরাসরি টেকনিক্যাল কোন ভূমিকা নেই বাংলাদেশের, তবু Thales Alenia Space বা SpaceX এর হয়ে এই প্রোগ্রামে যদি কোন বাংলাদেশি ভূমিকা রেখে থাকেন তবে তাদের বিনীত শ্রদ্ধা জানাই।

Falcon 9 Blocjk 5

বাংলাদেশের জন্য দিনটি অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ, তবে মহাকাশ যাত্রার ইতিহাস হিসাব করলেও দিনটার একটা গুরুত্ব থাকা উচিত। আজকের উৎক্ষেপণে SpaceX তাদের Falcon 9 এর Block 5 রকেট ব্যবহার করবে। এটাকে বলা হচ্ছে Falcon 9 এর সর্বাধুনিক এবং সর্বশেষ আপগ্রেড।  অর্থাৎ এর পরে Falcon 9 এ আর কোন পরিবর্তন আসবে না। ২০১১ সালে স্পেস শাটল প্রোগ্রাম বন্ধ হয়ে যাবার পর আমেরিকা থেকে কোন মানব অভিযাত্রীবাহী মহাকাশযান পরিচালিত হচ্ছে না। এখন SpaceX এর Falcon 9 Block 5 ই একমাত্র রকেট যেটা NASAর মানব অভিযাত্রীবাহী মিশন পরিচালনার জন্য সবগুলি স্ট্যান্ডার্ড ফলো করে। তবে SpaceX কে crewed mission এর কন্ট্রাক্ট পেতে হলে একটানা ৭ বার সফল উৎক্ষেপন চালাতে হবে এই রকেটে। সে জন্য আজকের উৎক্ষেপন তাদের জন্য একটা বড় পরীক্ষাই বটে। এর সাথে আরো কিছু বাণিজ্যিক ব্যাপার অবশ্য আছে। ২০১০-২০১৩ পর্যন্ত Falcon 9 v1, ২০১৩-১৬ v1.1 চলার পর এখন অব্দি v1.2 ছিল সর্বাধুনিক। তবে এই ভার্সনগুলি SpaceX এর বাণিজ্যে খুব বড় পরিবর্তন আনতে পারে নি। এর কারণ হল বাণিজ্যিকভাবে সফল হতে হলে স্পেস এক্স কে আরও বেশি ফ্লাইট পরিচালনা করতে হবে। তবে আগের ভার্সনগুলি একাধিকবার ব্যবহার করার সুযোগ থাকলেও সেটা বেশ সীমিত ছিল, দ্বিতীয়বার ব্যবহারের আগে বড়সড় সংস্কার কাজের দরকার হত। লেগে যেত কয়েক মাস। আর নতুন ভার্সনের ব্যাপারে বলা হচ্ছে এটা একটানা ১০ বার ব্যবহার করা যাবে উল্লেখযোগ্য সংস্কার ছাড়াই।

আজকের উৎক্ষেপণ সফল হোক এই শুভকামনা থাকল। আর ব্লক ৫ এর আপগ্রেডেশন গুলি নিয়ে বিস্তারিত লেখার ইচ্ছা আছে পাঠকদের অনুপ্রেরণা পেলে।

About the author

ঝেঁটুয়া

Leave a Comment