জীববিজ্ঞান

একটি ভুয়া পাখি : Ornithomimus

অর্নিথোমিমাস

বেশি কিছুদিন ধরেই একটা নতুন উটপাখি ডাইনোসরের চামড়া পরে আশেপাশে ঘুরে বেড়াচ্ছে। সেটা নিয়ে এলাকার বাসিন্দাদের মাঝে প্রবল বিরক্তি। ভয়ে আবার কেউ কাছেও যেতে চাইছে না। উটপাখিটা দেখতে থেরোপড ডাইনোসরদের মতন, আর থেরোপড মানেই বিপদ! কখন কাকে ধরে খেয়ে ফেলে বলা যায় না। এমনিতে যদিও এটা উটপাখি, কিন্তু ঝুঁকি নিয়ে কাজ কী?

তবে ভন্ডামি কতদিন আর সহ্য করা যায় বলুন?

বেশ বিরক্ত হয়ে তাই আজ সভার আয়োজন করা হয়েছে। মুটামুটি সব ধরনের প্রাণীই সেখানে উপস্থিত, তাদের মধ্যে বেশ কয়েকটা উটপাখিকেও দেখা যাচ্ছে। আজ একটা দফারফা করতেই হবে!

মহান বেবুন-রাজ সভার সূচনা করলেন, “নাহ, এই ছদ্মবেশী ডাইনোসরকে তো আর সহ্য করা যাচ্ছে না! দিনের পর দিন দূর থেকে আমাদের বোকা বানিয়ে যাচ্ছে সে আর আমরা ভীতুর মত দূরে দূরে থাকছি! বলুন আপনারা, এ কি মানা যায়?”

সবাই তাঁর কথার জোর বাড়ালো, “যায় না, মোটেও যায় না।“

চিতা এতক্ষন কী ভেবে যেন চুপচাপ বসে ছিল, এবার সে বললো, “হু। অন্যায় যে করে আর অন্যায় যে সহে, তব ঘৃণা তারে যেন তৃণসম দহে (লেখক কেবল কাহিনীর বর্ণনা করছেন। আফ্রিকান সাভানার চিতা কেমন করে বাংলা প্রবাদ আউড়ালো তার যুক্তি দিতে লেখক বাধ্য নন)।“

মহান বেবুন-রাজও গম্ভীর মুখে চিতার কথায় সমর্থন করলেন, “হু, যেন তৃণসম দহে। খুবই সুন্দর কথা। আজকের সভায় উপস্থিত উটপাখি বান্ধবগণ, আপনাদের জাতির যে কুলাঙ্গার আমাদের বোকা বানিয়ে চলেছে তার সম্পর্কে কিছু বলুন।“

উটপাখিদের একজন বললো, “সুযোগ দেওয়ার জন্য ধন্যবাদ। আপনারা জানেন আমরা কেউই ভয়ে তার কাছে ঘেষিনি। কিন্তু যতটুকু দেখেছি, সে আমাদের জাতির মতই দেখতে, শুধু বাইরে দিয়ে কোথা থেকে একটা ডাইনোসরের চামড়া যোগাড় করে এনে লাগিয়েছে। আমরা দূর থেকে লক্ষ্য করেছি, তার গতিও আমাদের মত প্রবল। সত্যি বলতে কি, সম্ভবত আমাদের থেকে বেশি ঘন্টায় চল্লিশ থেকে পঞ্চাশ মাইল মনে হয় হবে।“

“আরে এত চিল্লাপাল্লা করে লাভ আছে?” হায়েনার পাল হাসতে হাসতে তাদের মতামত জানালো, “গবেষণা মানুষের জন্যই থাক। চলুন আমরা সবাই মিলে গিয়ে ভন্ডটাকে হজম করে ফেলি। সব সমস্যার সমাধান।“

আশ্চর্যজনকভাবে কেউ এই কথার সাথে কোন দ্বিমত পোষন করলো না। তৃণভোজী যে কয়েকজন প্রাণী ছিল তারাও অন্য সবার সাথে চললো মজা দেখার জন্য।

উটপাখিটা একটা জায়গা ছেড়ে সাধারনত সরে না, সবাই সেখানকার কাছাকাছি গিয়ে হাজির হয়ে কোথাও না কোথাও লুকিয়ে গেল। প্ল্যানটা হচ্ছে হঠাৎ করে হাজির হয়ে ওটাকে চমকে দেওয়া। কিন্তু সব পরিকল্পণা কি ঠিকমত যায়? একটা পিচ্চি শেয়ালের যেন আর তর সইছিল না, সে একা কোথা থেকে লাফ দিয়ে হাজির হয়ে গেল, “হউ!”, আর সাথে সাথেই শুনা গেল তার ভয় ভয় গলায় চিৎকার, “ওরে বাবারে! খেয়ে ফেললো রে!”

আর কি থাকা যায়? একসাথে জন্তু-জানোয়ারের দল ঝাপ দিয়ে বের হয়ে এলো, “কী হলো, কী হলো?”

পিচ্চি শেয়াল ভয় ভয় গলায় বললো, “এ যে উটপাখি নয়, এ তো একটা সত্যি সত্যি…………”

আর কে যেন ঠিক তখনই বিরক্ত গলায় বললো, “আহ, এ কেমন যন্ত্রনারে ভাই? তোমরা কি একটা ডাইনোসরকে শান্তিতে বিলুপ্তও হতে দেবে না নাকি অ্যা?”

অর্নিথোমিমাস

“তোমরা কি একটা ডাইনোসরকে শান্তিতে বিলুপ্তও হতে দেবে না নাকি অ্যা?”

ঠিক তখন সবার মনে হলো, যাকে নিয়ে এত তোলপাড় সে তাদের সামনে। আর সে দেখতে মোটেও ডাইনোসরের চামড়া লাগানো উটপাখির মতো নয়। সে একটা সত্যিকারের ডাইনোসর! ডাইনোসরটা দেখতে অনেকটা উটপাখিদের মতই, এজন্য দূর থেকে দেখে ভূল হওয়াটাই স্বাভাবিক। তার শরীরে আবার হালকা পাতলা পালকও দেখা যাচ্ছে। এ কেমন করে সম্ভব?

গণ্ডার চিরকালই গম্ভীর প্রাণী, কিন্তু ঘটনার এ পরিণতিতে সেও অবাক না হয়ে পারলো না, “ভায়া, তুমি কি সত্যি সত্যি ডাইনোসর নাকি?”

উটপাখির-মত ডাইনোসর একটা লম্বা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো,”হ্যা। তোমাদের বিশ্বাস না হলে একজন প্যালেন্টোলজিস্টকে ডেকে নিয়ে এসো, সে পরীক্ষা করে বলুক আমি সত্যি ডাইনোসর কি না।“

“কিন্তু তুমি তো বিলুপ্ত প্রাণী। কোথা থেকে হাজির হলে ভাই তুমি?”

“সেটা যদি আমি নিজেই জানতাম। কোথাও কোন একটা গন্ডগোল হয়েছে। এটা তো আফ্রিকা, তাই না? তোমরা যে জায়গাটাকে উত্তর আমেরিকা বলো, এককালে সেদিকে আমি থাকতাম। কিন্তু সে তো প্রায় ষাট-সত্তর বছর আগের ক্রেটেশাস পিরিয়ডের কথা। কেমন করে যে আমি এখানে হাজির হলাম, আমিও বলতে পারছি না।“ এই বলে ডাইনোসর পাতা টেনে খেতে লাগলো।

পিছন থেকে কে যেন অবাক হয়ে বললো, “তুমি না থেরোপড? আমি তো জানতাম থেরোপডরা মাংশাসী।“

“না রে ভাই, মাঝখানে কোথায় যেন একটা বিবর্তন হয়ে গেছে, আমাদের প্রজাতি মাংশ ছেড়ে সেই কবে থেকে সবুজ ঘাস খাওয়া শুরু করেছে। সে দিক দিয়ে আমরা আলাদা, দুই একটা প্রজাতি ছাড়া কোন থেরোপডই তৃণভোজী নয়।“

মহান বেবুন-রাজ এ কথায় একটু সাহস পেলেন। এতক্ষণ তিনি লুকিয়ে ছিলেন এবার সামনে এসে জিজ্ঞেস করলেন, “তা আপনার নামটা কী যেন বললেন?”

অর্নিথোমিমাসের কঙ্কাল

অর্নিথোমিমাসের কঙ্কাল

“নাম বলি নাই। আমি হচ্ছি অর্নিথোমিমাস। আপনাদের এই উটপাখির মত দেখতে বলেই আমার এ নাম।“ এবার অর্নিথোমিমাসের চোখ কিছুটা অশ্রুসিক্ত হয়ে এল, “আহ, নাম জিজ্ঞেস করে আমাকে কেমন যেন আবেগাপ্লুত করে দিলেন। মনে পড়ে গেল, কী সব দিন গেছে আমাদের। পাল বেধে আমরা দৌড়ে বেড়াতাম এখানে সেখানে। বেশি বড় নই আমরা, দেখছেনই? অনেক বড় বড় ডাইনোসর শিকার করে বেড়াতো আমাদের, কিন্তু এতই কি সহজ? আপনাদের অনেক বিজ্ঞানী কিন্তু বলে থাকেন আমরা সবচেয়ে দ্রুতগামী ডাইনোসর ছিলাম, আর সেই আমাদের কী এত সহজেই ধরা যায়। আমাদের মস্তিষ্কও একেবারে ছোট ছিল না, কিন্তু অনেকে অবশ্য এই কারনে আমরা বেশি বুদ্ধিমান ছিলাম সে কথা বলতে নারাজ। আহারে, একেবারে শেষমূহূর্তে আমরা বিলুপ্ত হয়ে গেলাম। নাহলে দেখতেন আপনারা, বিবর্তনে আমাদের মস্তিষ্কের আকার আরও বেড়ে যেত।“

“সত্যিই আপনাদের শিকার করা কঠিন ছিল?”

“অবশ্যিই! আমাদের মত দ্রুত প্রাণীদের আটকানোর একমাত্র উপায় হচ্ছে আচমকা আক্রমণ। দেখেছেন কত লম্বা আমাদের ঘাড় আর কত বড় আমাদের চোখ? অনেক দূরে দেখতে পারি আমরা, দৃষ্টিশক্তিও ভালো। আমাদের ফাঁকি দেওয়া………হু হু………….এত সহজ না বুঝলেন?” এবার অর্নিথোমিমাস সন্দেহের চোখে জিভ বের করা হায়েনাদের দিকে তাকালো, “এই ব্যাটারা, এত খাই খাই করিস না বুঝছিস। এককালে আমাদেরও দাঁত ছিল, এখন ঘাস খাই বলে গরু হয়ে গেছি সেটা ভাবিস না আমাকে।“

এবার সবাই কিছুটা ঘাবড়ে গেল, ডাইনোসর সে যেমনই হোক, তাকে খ্যাপানো ঠিক না। মহান বেবুন-রাজ একটা ত্যালত্যালা হাসি দিয়ে বললেন, “আচ্ছা জনাব অর্নিথোমিমাস, পরে আপনার সাথে কথা হবে। আমরা এখন যাই, কেমন? বিদায়”

অর্নিথোমিমাস মাথা নেড়ে সায় জানালো, তারপর ব্যাস্ত হয়ে গেল নিজের কাজে।

সাদাকালো জেব্রাদের একজন অনেকক্ষন ধরে কিছু চিন্তা করছিল, যেতে যেতে সে বিরবির করলো, “এখন আমার মনে পড়েছে। আমি শুনেছিলাম অর্নিথোমিমাসদের ইতিহাস।“

হাতির সবচেয়ে ছোট যে বাচ্চা, সে তার ছোট ছোট চোখদুটো বড় বড় করে প্রশ্ন করলো, “শুনেছো?”

“হ্যা শুনেছি। অর্নিথোমিমিড ডাইনোসর ছিল যে কটি, তাদের মধ্যে একেবারে প্রথম দিকে পাওয়া গিয়েছিল অর্নিথোমিমাসের ফসিল। এত বিখ্যাত ডাইনোসর, কেন তার কথা আগে মনে পড়েনি বুঝতে পারছি না। প্রথম ফসিলটা পাওয়া গিয়েছিল ১৯৮৯ সালে, কলোরাডোর ডেনভার ফর্মেশনে। আর তাদের নামটি দেন ও. সি. মার্শ, সেটা আবার ঠিক পরের বছরই।“ জেব্রা স্বপ্নালু চোখে উপরের দিকে তাকালো, “দেখি, কদিন যাক, ওকে আমি আবার খুঁজে বের করবো। অনেকগুলো প্রশ্ন আমার করার আছে।“

বাচ্চা হাতি বললো, “আমাকেও সঙ্গে নিও কিন্তু।“

আফ্রিকার সাভানার একদল প্রাণী কিছুক্ষণ পর আলাদা হয়ে গেল হারানো অর্নিথোমিমাসদের স্মৃতি নিয়ে। আর সেই স্মৃতি সবচেয়ে বেশি গেঁথে রইলো সম্ভবত একপাল উটপাখি, সাদাকালো জেব্রা আর ছোট বাচ্চা হাতির মনে।

এরপর হারানো পৃথিবীর হারানো অর্নিথোমিমাসকে কেউ আর কোনদিন দেখতে পায়নি।

রিভিউ
Sending
User Review
3.5 (2 votes)

About the author

মৃন্ময় আকাশ

আপাতদৃষ্টিতে অযৌক্তিক পৃথিবীর যুক্তি অন্বেষনে।

Leave a Comment