১.
ডাইনোসর সম্পর্কে মোটামুটি ধারনা আছে এমন কাউকে যদি আমি প্রশ্ন করি, “উড়তে পারে এমন একটা ডাইনোসরের নাম বলতে পারেন?” তবে অনেকেই উত্তর দেবেন, “অবশ্যই পারি। টেরোডেক্টাইল!”
টিভি থেকে শুরু করে ইন্টারনেট, ইত্যাদির কল্যাণে যেসব ডাইনোসর দেখলেই চেনা যায় তাদের মাঝে এক নম্বরে থাকার কথা টি-রেক্সের, দুই নম্বরে হয়ত থাকবে টেরোডেক্টাইল। লম্বা মুখ আর বাদুড়ের মতন পাখা দেখেই চট করে বলে দেওয়া সম্ভব, “আরে এ যে দেখি টেরোডেক্টাইল, উড়ুক্কু ডাইনোসর!”
তবে উড়ুক্কু ডাইনোসর টেরোডেক্টাইল নিয়ে আমাদের যে কথাবার্তা বলা যাবে না। কারন টেরোডেক্টাইল তো কোন ডাইনোসরই নয়। প্রাগৈতিহাসিক যেকোন সরীসৃপ জাতের প্রাণী আমরা অনেকসময় ডাইনোসর বলে চালিয়ে দিতে যাই, কিন্তু এদের সকলে যে কিছুতেই ডাইনোসর নয়।
তবে ডাইনোসর ঠিক কাদের বলে এই প্রশ্নটার উত্তর দিতে পারা একটু কঠিন হয়ে যেতে পারে। কারন ডাইনোসর বললেই আমাদের মাথায় চলে আসে দাঁত খিঁচিয়ে দাড়িয়ে থাকা একটা টি-রেক্সের ছবি কিংবা বিল্ডিঙের সমান বড় বড় ডিপ্লোডোকাসের কথা। একেবারে ধরে বেঁধে ডাইনোসরের সংজ্ঞা দিয়ে দেওয়া খুব একটা সহজ কাজ নয়। কিন্তু তাই বলে কি ডাইনোসরের সংজ্ঞা নেই? আমাদের কি কেবল এটা বলতে হবে যে, “সেই প্রাচীন কালে পৃথিবীতে যেসব সরীসৃপ টাইপ প্রাণী ঘুরে বেড়াত তাদের ডাইনোসর বলা হয়”? সংজ্ঞাটা মোটেও ভাল হবে না কারন আগেই বলা হয়েছে পৃথিবীতে সেই যুগে চরে বেড়ানো সব সরীসৃপই ডাইনোসর ছিল না।
বিজ্ঞানীরা কিন্তু কারা ডাইনোসর এবং কারা নয় তার ভাগ অনেক আগেই করে রেখেছেন। আমরা জানি যে ডাইনোসররা ছিল সরীসৃপ, এবং আমাদের চেনা জানা সরীসৃপদের সাথে ডাইনোসরদের অবশ্যই তফাৎ আছে। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘মিশর রহস্য’ উপন্যাস থেকে করা ছবিটিতে কাকাবাবুর সংলাপের উদ্ধৃতি দেওয়া যাক, “টিকটিকি আর ডাইনোসর একগোত্রীয় হলেও, এক জিনিস নয়”।
তাহলে দেখা যাক ডাইনোসরদের কেমন করে আলাদা করা যায়। ডাইনোসররা প্রাচীন আর্কোসরদের বংশধর যারা ২৫০ মিলিয়ন বছর আগে পার্মিয়ান কিংবা ট্রায়াসিক সময়ে পৃথিবী জুড়ে যে ভয়ানক বিলুপ্তি ঘটেছিল তা থেকে বেঁচে গিয়েছিল। এরপর ধরা যাক ডাইনোসররা ছিল মাটির উপরের প্রাণী এবং তাদের সন্তান জন্ম পেত ডিম থেকে।
আর্কোসরদের অন্যান্য বংশধরদের থেকে (যেমন টেরোডেক্টাইল) কেমন করে ডাইনোরসরদের আলাদা করা যায় তাদের শরীরের ভিতরের গঠন থেকে। যেসব ডাইনোসর দুই পায়ের উপর ভর করে চলাফেরা করত তারা একটু উঁচু হয়ে অনেকটা এই যুগের পাখিদের মতন দাড়াত। চারপায়ীরা একেবারে শক্ত হয়ে থাকত এবং সোজা পা ফেলে চলাফেরা করত(হাতিদের মতন। আমাদের যুগের সরীসৃপরা কিন্তু সোজা পা ফেলে চলে না, তাদের পা ভাজ হয়ে থাকে)।
আরও বেশি ভিতরে ঢুকতে চাইলে বলতে হয় যে ডাইনোসরদের শ্রোণীচক্রে মানে পেলভিসে একটা ছিদ্র থাকত, যা নিঃসন্দেহে আলাদা একটা বৈশিষ্ট্য।
২.
একটা চমক দেওয়া যাক। ডাইনোসররা সম্ভবত এখনও বিলুপ্ত হয়নি!
সম্ভবত বলছি কারন এই প্রসঙ্গের সাথে মিশে আছে বিবর্তনবাদ এবং এই তত্ত্বের নির্ভুলতা সম্বন্ধে সন্দেহ থাকার যদিও কোন কারন নেই তবু ঠিক কেমন করে কোন প্রজাতির বিবর্তন হয়েছে তা আমরা নিশ্চিত ভাবে বলতে পারি না, কেবল অনুমান করা সম্ভব।
ধারনা করা হয় বিবর্তিত হতে হতে ডাইনোসররা বর্তমান পৃথিবীতে তাদের বংশধর রেখে গেছে। প্রচলিত শেণীবিন্যাস অবশ্য এই বংশধরদের ডাইনোসর বলতে রাজি না। কিন্তু অন্য এক বিশেষ ধরনের শ্রেণীবিন্যাসে এই বংশধরেরা ডাইনোসরদের মর্যাদা পেয়ে গেছে। তার চেয়েও বেশি আনন্দের ব্যাপার হচ্ছে এদের আমরা খুব সহজেই দেখতে পারি। ডাইনোসরদের বংশধরদের একটা উদাহরন দেওয়া যাক এবার : মুরগী! এমনকি এই লেখার প্রথমে যে ছবিটিকে আরেকটু হলেই ডাইনোসরের ফসিল বলে চালিয়ে দেওয়ার চেষ্টা চলছিল তা মোটেও ডাইনোসরের ফসিল নয় বরং মুরগীর কঙ্কাল।
আজকের পাখিরাই হচ্ছে ডাইনোসরদের রেখে যাওয়া বংশধর, সাপ-টিকটিকি-কুমির অর্থাৎ সরীসৃপেরা নয়। আমরা আগেই বলেছি যে ডাইনোসররা প্রাচীন আর্কোসরদের বংশধর। আর্কোসররা দুই ভাগে ভাগ হয়ে গিয়েছিল, তাই ডাইনোসরদেরও দুই ভাগে ভাগ করা যায় এবং তা আর কিছু নয় বরং কোমরের হাড়ের উপর নির্ভর করে।
এদের একভাগ ছিল সরিশিয়ান(saurischian) কিংবা ‘গিরগিটি-কোমর’ ডাইনোসরেরা। সরিশিয়ানদের আবার দুই ভাগ আছে, থেরোপড (যেমন : টি-রেক্স) এবং সরোপড(যেমন : ডিপ্লোডোকাস)। থেরোপডরা দুইপায়ের উপর চলাফেরা করত(বংশ অনুসারে ডাইনোসরদের যা করার কথা), কিন্তু সরোপডরা ছিল চারপেয়ে।
ডাইনোসরদের অপরভাগ হচ্ছে অর্নিথিশিয়ান(ornithischian) কিংবা ‘পাখি-কোমর’ ডাইনোসর(যেমন : ক্যাম্পটোসরাস, ইগুয়ানোডন)। এখানে আরেকটা মজার ব্যাপার হচ্ছে পাখিরা কিন্তু পাখি-কোমরেদের নয় বরং সরিশিয়ানদের বংশধর।
এটা মুটামুটি সবাই জানে যে কিছু ডাইনোসর ছিল মাংশাসী শিকারী এবং অধিকাংশই তৃণভোজী। এবং তাদের মাঝেও ছিল নানা বৈচিত্র্য। কোন কোন ডাইনোসরের শিং ছিল, অনেকের শরীরে পালক পর্যন্ত ছিল। অনেকের ধারনা থাকতে পারে যে ডাইনোসর মানেই ছোটখাট পাহাড়, কিন্তু ছোট সাইডের ডাইনোসরেরও আসলে কোন অভাব ছিল না।
তবে কোন ডাইনোসর সবচেয়ে বড় আর কোনটা সবচেয়ে ছোট এটা কিন্তু কখনই বলা সম্ভব নয়। কারন আমাদের ডাইনোসর সম্পর্কে জানার একমাত্র উপায় হচ্ছে ফসিল, আর সব প্রজাতির ডাইনোসরের যে হাজার হাজার ফসিল পাওয়া যাবে তা মোটেও সম্ভব নয়। সুতরাং এখন পর্যন্ত জানা সবচেয়ে বড় কিংবা সবচেয়ে ছোট ডাইনোসরের রেকর্ড যে কোন সময় হাতছাড়া হয়ে যেতে পারে।
এত কিছু বলার পর আরেকটা প্রশ্ন হয়তো এসে যাবে, ডাইনোসররা কতটা বুদ্ধিমান ছিল? যারা জুরাসিক পার্ক ছবিটা দেখেছেন তাদের একটা জায়গা হয়তো মনে থাকতে পারে যেখানে একটা ডাইনোসর (সম্ভবত একটা ভেলোসির্যাপ্টর) পা দিয়ে দরজার হাতল ঘুরিয়ে দরজা খুলে ফেলতে পারে, যা মোটেও সহজ কাজ নয়। তাহলে কতটা বুদ্ধিমান ছিল প্রাচীন সরীসৃপগুলো?
আসলে দুনিয়ার সবচেয়ে বুদ্ধিমান ডাইনোসর একটা বোকাসোকা কুকুরের সমান বুদ্ধিমানও ছিল কি না সন্দেহ। ডাইনোসরদের দেহের আকৃতির তুলনায় মস্তিষ্ক ছিল অনেক অনেক ছোট। তাই ওদের এতটা চালাক মনে করে দুঃখ করার কোন প্রয়োজন নেই, কারন সিনেমা যত সুন্দরই হোক কখনোই একশ ভাগ সঠিক হতে পারে না।