এক।
সন্তানের ঠাণ্ডা-জ্বর প্রায়ই লেগে থাকে। মায়ের দুশ্চিন্তার শেষ নেই। এলাকার ভাবি-বৌদিদের সাথে খোশ গল্পেও মন বসে না। একটাই যেন প্রশ্ন, ঠাণ্ডা-জ্বর-সর্দি থেকে কীভাবে আমার বাচ্চাকে দূরে রাখব? এর মধ্যে কয়েকবার এম,বি,বি,এস পাশ করা ডাক্তারও দেখিয়েছেন। ডাক্তারের আর সব উপদেশের ফাঁক দিয়ে মাথা চাড়া দিয়ে ওঠে যেন একটাই ধ্বনি, “ এই যে কয়েকটা ভিটামিন সি ট্যাবলেট সাজেস্ট করছি, ওকে নিয়মিত এগুলো খাওাবেন।” এমনকি মহল্লার প্রতিবেশিরাও প্রতিদিন একই কথা বলেন।
তমাল সাহেব ষাটোর্ধ। মাঝে মাঝে দুর্বল অনুভব করেন, মাথা ঘুরে পড়ে যাবেন, এই ভয় এখন তিনি প্রতিনিয়তই পান। বন্ধুরা সবাই তাঁকে নিয়মিত ভিটামিন ট্যাবলেট খেতে উপদেশ দেন।
দুই।
২০১১ সালের অক্টোবর ১০।
ইউনিভার্সিটি অফ মিনেসোটার বিজ্ঞানিরা ৩৯০০০ মহিলার উপর এক গবেষণায় আবিস্কার করলেন যে, যেসব মহিলারা পরিপূরক ভিটামিন ট্যাবলেট নিয়মিত খেতেন তাঁদের মৃত্যুহার অন্যদের চেয়ে বেশি। এর দুই দিন পর ক্লিভল্যান্ড ক্লিনিক এর গবেষকেরা ঘোষণা করলেন, যেসব পুরুষ নিয়মিত অতিরিক্ত ভিটামিন E গ্রহণ করেন, তাঁদের প্রস্টেট ক্যান্সারের ঝুঁকি বাকিদের থেকে বেশি।
তিন।
পলিংঃদ্য জিনিয়াস
১৯৩১, Caltech এর নবীন অ্যাসিস্ট্যান্ট প্রফেসর লাইনাস পলিং Journal Of American Chemical Society তে প্রকাশ করলেন এক অনবদ্য পেপার “The Nature Of The Chemical Bonds”, রিভিউয়ের জন্য যে পেপার জার্নাল প্রকাশক আইনস্টাইনকে দিলে আইনস্টাইন বলেছিলেন, “This paper is too complicated for me!” । সেই পেপার প্রকাশ হওয়ার আগে পর্যন্ত বিজ্ঞানিরা জানতেন, কেবল দুই প্রকার রাসায়নিক বন্ধন আছে, আয়নিক আর সমযোজী। আয়নিক বন্ধনে ইলেকট্রনের আদান প্রদান হয় আর সমযোজী বন্ধনে ইলেকট্রন শেয়ার ঘটে। পলিং দেখালেন, বিষয়টা অত সরাসরি হয় না, আসলে বেশিরভাগ যৌগের রাসায়নিক বন্ধন বিশুদ্ধ আয়নিক আর বিশুদ্ধ সমযোজী ধর্মের মাঝামাঝি। অর্থাৎ এর মাধ্যমেই পলিং আবিস্কার করে বসলেন পরমাণুর এক বিশেষ ধর্মঃ তড়িৎ ঋণাত্মকতা। এই তত্ত্বের মাধ্যমে বিজ্ঞানি মহলে সাড়া পড়ে গেল। ত্রিশ বছরের নবীন সায়েন্টিস্ট পলিং কেমিস্ট্রির সাথে কোয়ান্টাম মেকানিক্সের সংযোগ ঘটালেন। সেইসাথে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে মেধাবী তরুন বিজ্ঞানির খেতাব পেলেন সম্মানজনক ল্যাঙ্গমুর পদক ও সর্বকনিষ্ঠ হিসাবে National Academy Of Science এর সদস্যপদ অর্জনের মাধ্যমে। এমন কি এই গবেষণাই ১৯৫৪ সালে তাঁর হাতে এনে দিল তাঁর প্রথম নোবেল প্রাইজ।
১৯৪৯ সালে পলিং সায়েন্স ম্যাগাজিনে একটা নতুন গবেষণাপত্র প্রকাশ করলেন – “Sickle cell Anemia: A moleculer disease”। তাঁর আগে পর্যন্ত বিজ্ঞানিরা জানতেন, Sickle Cell Anemia আক্রান্ত মানুষের রক্তের হিমোগ্লোবিন জমাট বেঁধে যায় যা শেষ অব্দি রোগীর মৃত্যু ঘটায়। কিন্তু তাঁরা জানতেন না কেন এমনটি হয়। পলিং প্রথম দেখালেন, Sickle হিমোগ্লোবিনের চার্জ সাধারণ হিমোগ্লোবিনের থেকে কিছুটা ভিন্ন, আর এই জন্যই তা অক্সিজেনের সাথে বিরূপ ক্রিয়া করে। আর এই গবেষণার মাধ্যমেই জন্ম নিল বিজ্ঞানের নতুন শাখা ‘Moleuler Biology’।
১৯৫১ সালে Proceedings Of National Academy Of sciences এ পলিং এর গবেষণাপত্র “The Structures Of Protein” প্রকাশিত হওয়ার আগে পর্যন্ত বিজ্ঞানিরা শুধু এটুকু জানতেন যে, প্রোটিন তৈরি হয় সারি সারি অ্যামাইনো এসিড দিয়ে। পলিং প্রথম প্রস্তাব করলেন যে, প্রোটিনের সেকেন্ডারি কাঠামো রয়েছে এবং দেখালেন কীভাবে প্রোটিনগুলি একের পর এক প্যাঁচানো থাকে। তিনি এর নাম দিলেন আলফা হেলিক্স।
১৯৬১ সালে গোরিলা, শিম্পাঞ্জি আর হনুমানের রক্ত পরীক্ষা করে তিনি দেখালেন যে, হিমোগ্লোবিনের মিউটেশন ‘বিবর্তনের ঘড়ি’ হিসাবে ব্যবহার করা যায়। তিনি হিসাব করে বের করলেন, মানুষ অন্তত ১১ মিলিয়ন বছর আগে গোরিলা থেকে পৃথক প্রজাতি হিসাবে আত্মপ্রকাশ করেছে। তাঁর এক সহকর্মী বলেছিলেন, পলিং এক খোঁচায় জীবাশ্মবিদ্যা, আণবিক জীববিদ্যা আর বিবর্তন জীববিদ্যাকে একীভূত করেছিলেন!
লাইনাস পলিং শুধু কোয়ান্টাম ম্যাকানিক্স থেকে মলিকিউলার বায়োলোজিতেই বিচরণ করেন নি, বরং পঞ্চাশের দশক পরবর্তী চার দশক ধরে তিনি ছিলেন একজন প্রথম সারির শান্তিবাদী। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জাপানিজ অ্যামেরিকানদের অন্তরিত করে রাখা হয়েছিল, পলিং এর ঘোর বিরোধিতা করেন। ম্যানহাটন প্রজেক্টে যোগ দেয়ার জন্য তাঁর এক ঘনিষ্ট সহকর্মী অপেনহেইমার তাঁকে প্রস্তাব করেছিল, পলিং তা ফিরিয়ে দিয়েছিলেন। পলিং ধংসাত্নক নিউক্লিয়ার প্রযুক্তির বিস্তারের বিপক্ষে কাজ করেছেন, এমন কি সরকারের উপর চাপ প্রয়োগ করেছেন যাতে সরকার স্বীকার করে নেয় যে, নিউক্লিয়ার বিস্ফোরণ জীবের জিনগত পরিবর্তন ঘটাতে পারে। পলিং আরও অনেক নোবেল বিজয়ীদের নিয়ে ভিয়েতনাম যুদ্ধের বিরোধিতা করেছিলেন।
এবং বিশ্ব শানিতে অবদান রাখায় ১৯৬২ সালে লাইনাস পলিং পেলেন তাঁর দ্বিতীয় নোবেল- নোবেল শান্তি পদক! শুধু নোবেল কেন পলিং পেয়েছেন National Academy Of Science পদক, Medal for Merit, ক্যাম্ব্রিজ , লন্ডন ও প্যারিস ইউনিভার্সিটির অনারারি ডিগ্রি, ১৯৬১ তে টাইমস ম্যাগাজিনের Man Of The year. শুধু তাই নয় পলিংকে আজ পর্যন্ত বিশ্বের সেরা বিশ জন বিজ্ঞানির এক জন মনে করা হয়, এই তালিকায় বিংশ শতাব্দির এক জনই আছেন শুধু পলিংএর সাথে, তিনি স্বয়ং আলবার্ট আইনস্টাইন!
ফল অফ এ জিনিয়াসঃ
পরিশ্রম, চেষ্টা আর উচ্চ পর্যায়ের চিন্তাশীলতা যা পলিংকে একজন কিংবদন্তিতে পরিণত করেছিল তার সবকিছু যেন কোথায় হারিয়ে গেল একটা পর্যায়ে এসে। বিজ্ঞানের যুবরাজ পলিং হঠাৎই যেন হয়ে গেলেন সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ হাতুড়ে ডাক্তার !
সময়টা মার্চ, ১৯৬৬।
পলিং এর বয়স তখন পঁয়ষট্টি। নিউবার্গ পদক গ্রহণ অনুষ্ঠানে বক্তৃতাদানকালে তিনি বললেন, “বিজ্ঞানিদের নিত্যনতুন আবিস্কার আর প্রকৃতিকে জানার কাছাকাছি পৌঁছানোর প্রয়াসে আমি বরাবরই ভীষণ উত্তেজিত থাকি। নিউইয়র্ক সিটিতে এক সভাকালেও আমি এ কথা বলেছিলাম আর আশা প্রকাশ করেছিলাম যাতে আরও অন্তত পঁচিশ বছর বেঁচে থাকতে পারি এই আনন্দ পাওয়ার জন্য। ক্যালিফোর্নিয়া থেকে ফেরার পর আইরিন স্টোন নামে এক বায়োকেমিস্টের কাছ থেকে আমি একটা চিঠি পাই। সে লিখেছিল আমি যদি তাঁর কথা অনুসারে প্রতিদিন ৩০০০ মিলিগ্রাম করে ভিটামিন সি সেবন করি তাহলে পঁচিশ কেন, আমি হয়ত আরও অনেক বছর ধরে বাঁচতে পারব। আমি তাঁর কথামত ভিটামিন সি গ্রহণ করতে শুরু করলাম। এর আগে আমি প্রায়ই ঠাণ্ডা-জ্বরে ভুগতাম। কিন্তু ভিটামিন সি নিয়মিত গ্রহণের পর থেকে তা আর কখনও হয় নি।কয়েক বছর পর আমি ভিটামিন সি সেবনের মাত্রা দশগুণ বাড়িয়ে দিলাম, তারপর বিশ গুণ, তারপর তিনশ’ গুণ। এখন আমি প্রতিদিন ১৮০০০ মিলিগ্রাম ভিটামিন সি সেবন করি…আর এখন আমি নিজেকে অনেক বেশি সুস্থসবল মনে করি।”
এরপর থেকে লাইনাস পলিংকে বিশ্বের মানুষ চিনতে শুরু করল নতুন কিছুর জন্য- ভিটামিন সি!
১৯৭০ সালে পলিং প্রকাশ করলেন তাঁর বেস্ট সেলার বই Vitamine C And The Common Cold। এই বইয়ে তিনি সবাইকে দৈনিক ৩০০০ মিলিগ্রাম ভিটামিন সি সেবনের পরামর্শ দিলেন। পলিং ধারণা করেছিলেন ভিটামিন সি সেবনের মাধ্যমে খুব শিগগিরি ঠাণ্ডা-জ্বরকে চিরবিদায় জানানো যাবে। পলিং এর পরামর্শে ভিটামিন সি’র চাহিদা এত বেড়ে গেল যে উৎপাদনকারিরা রীতিমত হিমসিম খেতে শুরু করল। তাঁরা এর নাম দিল “দি লাইনাস পলিং ইফেক্ট ”
তবে বৈজ্ঞানিকমহল এতটা আগ্রহী ছিলেন না তা পলিং এর তত্ত্বের উপর।পলিং এর বইটি প্রকাশের আরও ত্রিশ বছর আগে ইউনিভার্সিটি অফ মিনেসোটার বৈজ্ঞানিকেরা ঠাণ্ডা-জ্বরের উপর ভিটামিন সি এর প্রভাব নিয়ে গবেষণা করেছিলেন। তাঁরা শেষ পর্যন্ত এই সিদ্ধান্তে এসেছিলেন যে, শুধু ভিটামিন সি বা শুধু অ্যান্টিহিস্টামিন বা ভিটামিন সি ও অ্যান্টিহিস্টামিন একত্রে শ্বাসযন্ত্রের সংক্রমণের মাত্রা বা সংক্রমণকালের দৈর্ঘ্য কোনটার উপরই উল্লেখযোগ্য প্রভাব ফেলতে পারে না। এই পরিক্ষাটি তারা করেছিলেন ৯৮০ জন রোগীর উপর।
কিন্তু পলিং এর মত এক জন এত বড় মাপের বিজ্ঞানির কাছ থেকে ভিটামিন সি এর আশ্চর্য কার্যকারিতার কথা শুনে বিজ্ঞানিরা বসে থাকতে পারলেন না। ইউনিভার্সিটি অফ মেরিল্যান্ডের বৈজ্ঞানিকেরা ১২ জন ভলান্টিয়ারের উপর এবং ইউনিভার্সিটি অফ টরেন্টোর বৈজ্ঞানিকেরা ৩৫০০ জ1নের উপর গবেষণা করলেন। কিন্তু ঠাণ্ডার উপর ভিটামিন সি এর কোন কার্যকারিতা খুজ পেলেন না। এমন কি ২০০২ সালে এসে নেদারল্যান্ডের বিজ্ঞানিরাও একই গবেষণা করলেন, কিন্তু ফল পরিবর্তিত হল না কখনই! অন্তত পনেরটা গবেষণা নিশ্চিত করেছে যে ঠাণ্ডাজ্বর সারার উপর ভিটামিন সি’র কোন প্রভাব নেই।
যাহোক, যদিও একের পর এক গবেষণা বলছিল যে পলিং এ’র ভিটামিন সি তত্ত্ব সঠিক ছিল না, মহান পলিং সব গবেষণা প্রত্যাখ্যান করলেন। উল্টে বিভিন্ন যায়গায় বক্তৃতায় ভিটামিন সি’র নামে সাফাই গাইতে লাগলেন। অনেক অনেক নিবন্ধ আর বই লিখতে লাগলেন একে সমর্থন করে।
এরপর পলিং আরও এক ধাপ এগিয়ে বললেন, ভিটামিন সি শুধু ঠাণ্ডার অসুখেই কার্যকরী নয়, বরং তা ক্যান্সারও সারায়! ১৯৭১ সালে গ্লাসগো’র একটা ছোট্ট হাসপাতালের স্কটিশ ডাক্তার এওয়ান ক্যামেরন পলিংকে এক চিঠিতে জানান যে, তাঁর হাসপাতালে যেসব ক্যান্সার রোগীকে দিনে ১০ গ্রাম করে ভিটামিন সি দেয়া হত তাঁদের উন্নতি অন্যদের চেয়ে বেশি হয়েছে। পলিং এতে ভীষণ উৎফুল্ল হন এবং দ্বিগুণ উৎসাহে তাঁর ভিটামিন তত্ত্ব ছড়িয়ে দিতে উদ্যোগী হয়ে পড়েন। তিনি ডাক্তার ক্যামেরনের আবিস্কারকে Proceedings of the National Academy of Sciences এ প্রকাশ করতে মনস্থির করেন। একাডেমির সদস্য হিসাবে পলিং এর ধারণা ছিল যে, তিনি ইচ্ছা করলেই ওই জার্নালে তাঁর পেপার প্রকাশ করতে পারবেন। কিন্তু শেষ অব্দি তাঁর পেপার প্রত্যাখ্যাত হয়, Oncology নামের অন্য একটি জার্নালে তিনি সেই পেপার প্রকাশ করেছিলেন। ক্যান্সার বিশেষজ্ঞদের জার্নাল Oncology তে প্রকাশের কারণে বিজ্ঞানিরা পলিং এর ডাটা গুরুত্বের সাথে যাচাই বাছাই করতে শুরু করেন, কিন্তু তাঁরা দেখেন যে, ক্যামেরন যে রোগীদের ভিটামিন সি খাইয়েছিলেন তাঁরা থেরাপির শুরুতেই অপেক্ষাকৃত সুস্বাস্থ্যের অধিকারি ছিলেন তাই ক্যামেরন তাঁদের থেকে ভাল ফলাফল পেয়েছিলেন।
কিন্তু লাইনাস পলিংকে কোনমতেই তাঁর সমালোচিত ভিটামিন সি তত্ত্ব থেকে সরানো গেল না। পলিং এবার বললেন, ভিটামিন সি সেবন ক্যান্সারে মৃত্যুহার ১০ শতাংশ কমাতে পারে। ১৯৭৭ সালে তিনি আরও এগিয়ে বললেন, “আমার সাম্প্রতিক গবেষণা বলছে শুধু ভিটামিন সি সেবনেই ক্যান্সারে মৃত্যুহার ৭৭% কমানো যাবে! আরও কমানো যাবে যদি অন্যান্য পুষ্টিকর পরিপূরক খাদ্য খাওয়ানো হয়।” তিনি বললেন, ভিটামিন সি ব্যবহারে মানুষের আয়ু বেঁড়ে ১০০-১১০ বছর এমন কি এক সময় ১৫০ বছরেও দাঁড়াবে। Oncology জার্নালের সম্পাদক ও ফিলাডেলফিয়া চিলড্রেন’স হসপিটালের Center For Childhood Cancer Research এর ডিরেক্টর জন ম্যারিস বলেন, সেই সময়ে রোগীদের পরিবার রোগীকে ভিটামিন সি দেয়ার জন্য প্রায়ই অনুরোধ করত। আমরা বুঝাতে পারতাম না তাঁদের। তাঁরা বলত, আপনি কি নোবেল পেয়েছেন?
ক্যান্সার গবেষকেরা পলিং এর থিওরি পরীক্ষা করতে চাইলেন। মায়ো ক্লিনিকের চার্লস মর্টেল ১৫০ জন ক্যান্সার রোগির উপর গবেষণা করলেন। এদের ৭৫ জনকে প্রতিদিন ১০ গ্রাম করে ভিটামিন সি দেয়া হল, বাকিদের দেয়া হল না। গবেষণায় ভিটামিন সি গ্রহীতাদের আয়ুস্কালে কোন উন্নতি পাওয়া গেল না। পলিং এতে ক্ষুব্ধ হয়ে চিঠি লিখলেন New England Journal Of Medicine এ। তিনি দাবি করলেন মর্টেল যাদের ভিটামিন সি দিয়েছিলেন তাঁদের আগে কেমোথেরাপি দেয়া হয়েছিল। ভিটামিন সি সেইসব ক্যান্সার রোগীদের উপর কাজ করবে যাদের আগে কখনওই কেমোথেরাপি দেয়া হয় নি।
মর্টেল তাঁর গবেষণা আবার করলেন, এবার করলেন যাদের কেমো দেয়া হয় নি তাঁদের উপর, এবার ভিন্ন কোন ফল পেলেন না, এবং সিদ্ধান্ত টানলেন, ক্যান্সারের মত ভয়াবহ ব্যাধীতে ভিটামিন সি কোন উপশমের মাধ্যম নয়, তাতে রোগীকে আগে কেমো দেয়া হোক কি না হোক।
কিন্তু মানলেন না ডাবল নোবেল লরিয়েট বিজ্ঞানি স্যার লাইনাস পলিং। পলিং মর্টেলকে ঠক বলে আখ্যায়িত করলেন, এমন কি এ নিয়ে তিনি আইনজীবীদের সাথেও কথা বললেন, অবশ্য তাঁদের অভয় না পাওয়ায় লাইনাস আদালতে গেলেন না।
এত কিছুতেও পলিং দমলেন না। তিনি দাবি করলেন, যদি অতিরিক্ত মাত্রায় ভিটামিন এ (২৫০০০ IU) ভিটামিন ই, (৪০০ থেকে ১৬০০ IU) , সেলেনিয়াম (মৌলিক পদার্থ) আর বিটাক্যারোটিনএর সাথে ভিটামিন সি গ্রহণ করা যায় তাহলে সুহদু ঠাণ্ডা লাগা বা ক্যান্সার নয়, মানব দেহের যেকোন রোগ সেরে যেতে পারে। পলিং আরও দাবি করে বসলেন, ভিটামিন আর পরিপূরক পুষ্টি গ্রহণে হার্ট ডিজেজ, মানসিক সমস্যা, নিউমোনিয়া, হেপাটাইটিস, পোলিও, যক্ষ্মা, হাম, মাম্পস, বসন্ত, মেনিনজাইটিস, টাইফয়েড, ধনুষ্টংকার, ক্ষত, বার্ধক্য, অ্যালার্জি, অ্যাজমা, পানিশূন্তা, হুপিং কাশি, স্ট্রোক, মূত্রনালির পীড়া, পানিশূন্যতা, সাপের কামড়, উচ্চতাভীতি, পোড়া, ভাঙ্গা তেজস্ক্রিয় বিষক্রিয়া- সব কিছুতেই ভিটামিন কাজ করবে। এমন কি ১৯৭০ সালে যখন অ্যামেরিকাতে AIDS ধরা পড়ল, লাইনাস বললেন, ভিটামিন এটিকেও উপশম করতে পারবে!
পলিং এর এইসব মুখরোচক আজ্ঞা রোগে মানল না, সব গবেষণাতেই তাঁর উল্টো ফল পাওয়া গেল । তবুও পলিংর বিশ্বাস এই ভিটামিনের ভেতরে এমন কিছু আছে যা সব রোগ সারাতে পারে। আসলে পলিং এর সেই এমন কিছু হল ”অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট”
অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট কী জিনিস?
আমাদের কোষের ‘শক্তিকেন্দ্র’ হিসাবে পরিচিত হল মাইটোকন্ড্রিয়া। এখানে খাদ্য, শক্তিতে রূপান্তরিত হয়। এসময় অক্সিজেন প্রয়োজন হয়। তাই একে বলা হয় জারণ (oxidation)। এসময় মুক্তমূলক তৈরি হয়। যারা একটু আধটু রসায়ন পড়েছে তাঁরা জানে, এই মুক্তমূলকগুলি আসলে খুউব ক্রিয়াশীল। এরা সামনে কোষঝিল্লি, DNA, ধমনী যা-ই পাক তা ধ্বংস করতে চেষ্টা করে। এজন্য বার্ধক্য, ক্যান্সার, এমন কি হার্ট ডিজেজের সাথেও এর যোগাযোগ দেখা যায়। কিন্তু আমাদের শরীর হল এক আল্টিমেট প্রহরী। মুক্তমূলককে প্রশমিত করার জন্য তাই সে তৈরি করে অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট। এই অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট ফলমূল ও শাকসব্জীতে, বিশেষত সেলেনিয়াম, বেটা ক্যারোটিন আর ভিটামিন A,C,E তে প্রচুর পরিমানে পাওয়া যায়। গবেষণা থেকে দেখা যায়, যারা বেশি বেশি শাকসবজি আর ফলমূল খান তাঁদের মধ্যে ক্যান্সার, হার্ট ডিজেজের হার অনেক কম। সুতরাং অবশ্যই যুক্তি দেখানো যায় যে, এসব অ্যান্টিঅক্সিডেন্টযুক্ত খাবার খেলে সুস্বাস্থ্যের অধিকারি হওয়া যায়, তাহলে বাইরে থেকে অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট গ্রহণ করব না কেন?????
কিন্তু বাস্তব গবেষণা সব সময় বলছে উল্টো কথা। ১৯৯৪ সালে ২৯০০০ তীব্র ধূমপায়ী ফিনিশ নাগরিকের উপর, ১৯৯৬ সালে এসবেস্টসের সংস্পর্শে থাকা ও ফুস্ফুস ক্যান্সারের ঝুঁকিপূর্ণ মানুষের উপর অতিরিক্ত অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট প্রয়োগ করেও কোন ফল পাওয়া গেল না। উপরন্তু দেখা গেল হার্ট ডিজেজ ও ক্যান্সারে অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট গ্রহীতাদের মৃত্যুহার অন্যান্যদের চেয়ে বেশি (দ্বিতীয়টিতে হার্ট ডিজেজ ও ক্যান্সারে যথাক্রমে ১৮ ও ২৭% পর্যন্ত বেশি)
এরপর ২০০৪ এ ১৭০০০০ মানুষের উপর, ২০০৫ এ ১৩৬০০০ মানুষের উপর গবেষণাতেও কোন ভিন্ন ফল পাওয়া যায় নি। ২০০৭ এ আমেরিকার ন্যাশনাল ক্যান্সার ইন্সটিটিউটএর ১১০০০ পুরুষের উপর গবেষণায় দেখা যায়, যারা নিয়মিত অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট গ্রহণ করে তাঁদের প্রোস্টেট ক্যান্সারে মৃত্যুহার অন্যদের তুলনায় দ্বিগুণ। ২০১১ সালের অক্টোবরের রিপোর্টের কথা শুরুতেই উল্লেখ করেছি।
অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট যেখানে দেহের বন্ধু, অ্যান্টিঅক্সিডেন্টযুক্ত শাক্সব্জি-ফলমূল খেলে যেখানে স্বাস্থ্যের উন্নতি হয় সেখানে বাইরে থেকে অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট গ্রহণে স্বাস্থ্যঝুঁকি কেন দেখা দিচ্ছে??
বিজ্ঞানিরা বলছেন, মাইটকন্ড্রিয়াতে শ্বসনে উৎপন্ন মুক্তমূলক আসলে ততটা ক্ষতিকর নয় যতটা তাদেরকে বলা হয়। বরং অনেক সময় অনেক ক্ষতিকর জীবাণু যা দেহে মারাত্নক কিছু সৃষ্টি করতে পারে, এমনকি ক্যান্সার কোষ তাকেও এই মুক্তমূলকগুলি ধ্বংস করতে পারে। কিন্তু অতিরিক্ত মাত্রায় অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট সেবন করলে এই মুক্তমূলকের উপস্থিতি পুরোপুরি বিলুপ্ত হয়। এসময় মুক্তমূলকের ভারসাম্য নষ্ট হওয়ার ফলে এক কৃত্রিম অবস্থার সৃষ্টি হয়, যার ফলে শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা ঠিকমত কাজ করতে পারে না। ফলশ্রুতিতে শরীর সহজেই রোগজীবাণুর জন্য আক্রম্য হয়ে পড়ে।
কারণ, যাই হোক না কেন, সাম্প্রতিক ও পুরাতন সব গবেষণায় এটা নিশ্চিত, ভিটামিন তথা অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট শাকসবজি ফলমূলের মাধ্যমে গ্রহণ করা ছাড়া বাইরে থেকে নিয়মিত ট্যাবলেট বা ক্যাপ্সুলের মাধ্যমে গ্রহণ করা ঠিক যুক্তিযুক্ত না, অন্তত কোন আন্তর্জাতিক সংস্থা তো তা রিকমেন্ড করে না।
চার।
১৯৮০ সালে এক সাক্ষাৎকারে স্যার লাইনাস পলিংকে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল, অতিরিক্ত ভিটামিনের কোন পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া আছে কি না। উত্তরে তিনি একটি কথাই বলেছিলেন, “না।”
এর ঠিক সাত মাস পর তাঁর স্ত্রী পাকস্থলির ক্যান্সারে মারা যান। আর প্রোস্টেট ক্যান্সারে পলিং নিজে ১৯৯৪ সালে মৃত্যুবরণ করেন।
রেফারেন্সঃ দি আটলান্টিক, উইকিপিডিয়া