কোয়ান্টাম কম্পিউটার নিয়ে কথা বলার আগে বলে রাখা ভালো যে দুই বিষয়েই আমার জ্ঞান ভাসাভাসা। অর্থাৎ, ভূলত্রুটি হতেই পারে ব্যাখ্যা করতে গিয়ে। তাই পাঠকের উচিৎ একশভাগ বিশ্বাস লেখাটাকে না করা। তবে, যেহেতু আমি জটিল কোন অংশে যাচ্ছি না তাই আশা করা যায় ভূল হবে না। আর কারও কারও নাম নিয়ে আপত্তি থাকলে আমার কিছু করার নেই, Quantum Computer এর জন্য ‘কণাবাদী গণনাযন্ত্র’ ছাড়া অন্য কোন ভালো বঙ্গানুবাদ পেলাম না।
যা হোক, আসল কথায় আসা যাক। কেউ যদি চাচা চৌধুরীর কমিকস পড়ে থাকে তাহলে জানে কাটুনিস্ট প্রাণ বারবার একটা কথা সবাইকে মনে করিয়ে দিয়েছেন, যা হলো ‘চাচা চৌধুরীর বুদ্ধি কম্পিউটারের চেয়ে প্রখর’। এ থেকে দুটি তথ্য পাওয়া যায়।
- কার্টুনিস্ট তার চরিত্রকে ভয়ানক বুদ্ধিমান প্রমাণ করতে চেয়েছেন।
- তিনি সফল হতে পারেননি।
হ্যা, তিনি সফল হতে পারেননি। কারণ আমাদের যে কারও বুদ্ধি
আসলে কম্পিউটারের চেয়ে প্রখর। কম্পিউটার আসলে গাধাটাইপ জিনিস, এর বুদ্ধির একটা উদাহরন দেওয়া যাক। ধরি, আমাদের একটা সমস্যা দেওয়া হলো। দুটো জায়গা A ও B, একটা থেকে অন্যটায় যাওয়ার অনেকগুলো রাস্তা। আমাদের প্রতিদ্বন্দ্বী একটা কম্পিউটার। সবচেয়ে ছোট পথটা বের করতে হবে।
সমস্যাটা সমাধানের জন্য আমরা কাজ করব বুদ্ধিমানের মত। আমরা জানি যে দুটি বিন্দুর মাঝে সবচেয়ে ছোট রাস্তাটা হলো এদের সংযোজক সরলরেখা। তাই আমরা প্রথমে মনোযোগ দিয়ে সবগুলো রাস্তা দেখব, তারপর যে রাস্তাটা সরলরেখার সবচেয়ে কাছাকাছি মনে হবে সেটাকে উত্তর দিয়ে দিব।
এখন দেখা যাক কম্পিউটার কি করবে। কম্পিউটার আমাদের মত ধুরন্ধর নয়। তার আছে কেবল চমৎকার নিখুঁতভাবে কাজ করার দক্ষতা আর অসাধারন স্মৃতিশক্তি। তাই সে প্রথমে সবগুলো পথ দিয়েই একবার করে যাবে, যেতে কতক্ষণ সময় লাগলো তা হিসেব করবে, যাওয়া শেষ করার পর কম্পিউটার দেখবে কোনটা দিয়ে যেতে সময় কম লাগলো, তারপর উত্তরটা সে দিতে পারবে।
দুঃখজনক হলেও, জিতবে কম্পিউটার। কারণ আর কিছুই নয়, এর দ্রুততা। আমরা রাস্তা দেখা শুরু করতে যাওয়ার সাথে সাথে কম্পিউটার এত সব কাজ শেষ করে উত্তরটা জেনে যাবে। আমাদের থেকে কম্পিউটারের গতি আর নির্ভুলতা অনেক বেশি, যে কারণে এদের আমাদের প্রয়োজন হয়।
কম্পিউটার মানে আমরা এখন যা ব্যবহার করি সে কম্পিউটার হিসেব করে Bit দিয়ে। এক বিট বলতে বুঝায় হয় 0 নয় 1। কম্পিউটার আসলে 0 আর 1 ছাড়া কিছু বুঝে না। হার্ডওয়ারের মাঝে না গিয়েও আমরা 0 আর 1 এর ধারনাটা পেতে পারি। ধরা যাক, আমাদের বলা হলো 8 আর 9 যোগ করতে। কাজটা আমাদের জন্য সহজ, আমরা জানি উত্তরটা 17। এখন যদি কম্পিউটারকে একই কাজ করতে বলা হয়, কম্পিউটার 8 আর 9 কে প্রথমে বাইনারিতে রূপান্তর করবে। বাইনারি হলো দুই ভিত্তিক সংখ্যা ব্যবস্থা, এতে 0 আর 1 ছাড়া অন্য কোন অঙ্ক থাকে না। যেমন আমাদের দশ অঙ্কের দশ ভিত্তিক বা ডেসিমেল সংখ্যা ব্যবস্থা। যা হোক, কম্পিউটার 8 আর 9 কে বাইনারি বা 0 আর 1 এর সংখ্যায় রূপান্তর করবে, তারপর যোগটা করবে। এমনকি যোগ করার কাজটাকে যে আমরা করতে বললাম, এই নির্দেশটাও কম্পিউটার বদলে দেবে 0 আর 1 এর একটা কোডে। 0 আর 1 দিয়ে আমরা না-হ্যা বুঝাতে পারি। কম্পিউটার যুক্তি প্রয়োগের জন্য ব্যবহার করে বুলিয়ান অ্যালজেবরা, যে জিনিসটাও সেই 0 আর 1 দিয়েই কাজ করে।
প্রশ্ন হলো, 0 আর 1 কে রূপান্তর করে বুঝলাম, কিন্তু কম্পিউটারের ‘যন্ত্রের ভেতরের কল ঘুরার’ সময় এগুলো কি কাজে লাগে? আমি আগেই বলেছি হার্ডওয়ারে যাব না, তাই সহজ ভাষায় – 0 আর 1 দিয়ে বন্ধ খুলা বুঝানো যায়। কম্পিউটারে অসংখ্য বৈদ্যুতিক সুইচ থাকে, যেগুলো বন্ধ আর খোলার অসংখ্য বিন্যাস দিয়ে কম্পিউটার আলাদা আলাদা নির্দেশ পালন করতে পারে।
কম্পিউটার গেল, এখন আসি কোয়ান্টাম থিওরিতে। যাদের কোয়ান্টাম মেকানিক্সের ধারনা আছে তারা জানে এটা বেশ বিদঘুটে একটা তত্ত্ব, এর থিওরিগুলো একরকম অবিশ্বাস্য, স্বয়ং আইনস্টাইন কোয়ান্টাম মেকানিক্সের কঠোর বিরোধী ছিলেন। কোয়ান্টাম মেকানিক্সের বিষয় হচ্ছে ইলেকট্রন-ফোটন এসব ছোট ছোট কণার জগৎ। আমাদের চারপাশের বিশ্ব যেরকম, ওদের জগৎ মোটেও সেরকম হয় না। এই থিওরি এতটাই চমকপ্রদ যে ইচ্ছে করলে হাজার হাজার পৃষ্ঠা লিখে ফেলা যায়, কিন্তু আমরা দু একটা প্রয়োজনীয় বিষয়ের আলোচনা করি।
প্রয়োজনীয় বিষয়গুলোর একটা হচ্ছে সুপারপজিশন। আমার সুপারপজিশনের ব্যাখ্যা মোটেও সত্যিকারের কোয়ান্টাম মেকানিক্সের মত হবে না, বিজ্ঞানীরা পড়লে ঝাড়ু হাতে তেড়ে আসতে পারে, কিন্তু তবুও চেষ্টা করে দেখা যাক।
আলোর যে সব ধর্ম আছে তাদের একটা হচ্ছে ব্যতিচার বা Interference। আলোর ব্যতিচার ধর্ম আলোর তরঙ্গ তত্ত্ব(যে আলো একপ্রকার তরঙ্গ এই তত্ত্ব) দিয়ে ব্যাখ্যা করা যায়(তার বড় কারণ যে ব্যতিচার আসলে সব রকমের তরঙ্গেরই একটা বৈশিষ্ট)। যেমন ধরা যাক, টমাস ইয়ং এর ডাবল স্লিট এক্সপেরিমেন্ট এর কথা। এক্সপেরিমেন্টটা নিয়ে আমি কিছু লিখছি না, কেউ আগ্রহী হলে পড়ে নিতে পারে অন্য কোথাও হতে। ডাবল স্লিট এক্সপেরিমেন্ট(ওরফে ব্যতিচার) আলোর তরঙ্গ তত্ত্ব দিয়ে ব্যাখ্যা করা সম্ভব, কণা তত্ত্ব দিয়ে যায় না। আলোর বর্তমানে সর্বসম্মত কোয়ান্টাম তত্ত্বও ব্যতিচার ব্যাখ্যা করতে পারে, তখন যে ধারনার প্রয়োজন হয় তা হলো সুপারপজিশন।
সুপারপজিশনের ধারনাটা আমাদের বলে, ইলেকট্রনের মত ক্ষুদ্র কণা একই সাথে অনেকগুলো জায়গায়, আরও ভাল করে বলতে গেলে অনেকগুলো অবস্থায় থাকতে পারে। ক্ষুদ্র কণার এই সবগুলো অবস্থানকে এর Position না বলে বলা হয় Superposition। আরও আশ্চর্য ব্যাপার হচ্ছে, যখন আমরা এর যে কোন একটা Superposition এ কণাটিকে খুঁজে পাই, কিছু মাপার চেষ্টা করি, সহজ কথায় অন্তত একটার অস্তিত্ব নিশ্চিত করার জন্য কিছু করি, তখনই কণার অন্য অস্তিত্বগুলো একেবারে উধাও হয়ে যায়! যেন কণাটি আমাদের দেখতে দিতে চায় না যে সে একইসাথে দুইভাবে আছে!
কোয়ান্টাম কম্পিউটার সুপারপজিশনকে কাজে লাগায়। আমরা জানি আমাদের কম্পিউটার বিট ভিত্তিক হিসেব করে। এক বিট মানে 0 অথবা 1। কোয়ান্টাম কম্পিউটারে বিট থাকে না, থাকে Qubit। এক Qubit মানে 0 অথবা 1 …….অথবা একইসাথে 0 এবং 1। সুপারপজিশন!
স্পষ্ট হলো না? একটা ছোট উদাহরন দিচ্ছি। আমাদের রাস্তা মাপার সমস্যাটা মনে আছে? আমরা জানি কোয়ান্টাম কম্পিউটারও গাধা টাইপ, সেও প্রতিটি রাস্তা মেপে দেখবে। কিন্তু কোয়ান্টাম কম্পিউটার প্রতিটি রাস্তা একটার পর একটা মাপবে না, যেটা করবে আমাদের কম্পিউটারগুলো। কোয়ান্টাম কম্পিউটার সবগুলো একইসাথে মেপে ফেলবে। কারন সুপারপজিশন মানেই একসাথে অনেকগুলো জায়গায় থাকতে পারা। কোয়ান্টাম কম্পিউটার এমনভাবে মাপবে যেন প্রতিটা রাস্তায় একইসাথে সে আছে, শেষপর্যন্ত যা উত্তর চাওয়া হয়েছিল সেই রাস্তাটায় তার অস্তিত্ব থাকবে। ধরা যাক 1 মিলিয়ন রাস্তা আছে, প্রতিটা দিয়ে যেতে 1 সেকেন্ড লাগে(আসলে আরও অনেক কম)। তাহলে পুরো কাজটা করতে পুরনো আমলের কম্পিউটারের লাগবে 1 মিলিয়ন সেকেন্ড, কোয়ান্টাম কম্পিউটারের 1 সেকেন্ড!
বাস্তবে তো কম্পিউটার আর এভাবে রাস্তা মাপতে যাবে না, আমি কেবল একটা উদাহরন দিলাম। কিন্তু কম্পিউটারে কাজ করার সত্যিকারের পদ্ধতির সাহায্যেও উদাহরন দেওয়া সম্ভব, সেটা একটু জটিল হতো এই যা। কিন্তু আসল কথা হলো, classical physics এর বদলে quantum physics এর নীতি ব্যবহার করায় কোয়ান্টাম কম্পিউটারের ক্ষমতা হয় যাবে অবিশ্বাস্য। একটা সাধারন কোয়ান্টাম কম্পিউটার সম্ভবত আমাদের 10^500 টি কম্পিউটারের কাজ একাই করতে পারবে!
প্রশ্ন হচ্ছে, আমরা কোয়ান্টাম কম্পিউটার বানাচ্ছি না কেন? একটা জবাব অবশ্যই যে যন্ত্রটা বানানো সহজ নয়, এখনও সব প্রাথমিক পর্যায়ে আছে। কিন্তু আসল কারন অন্য। আগেই বলেছি সুপারপজিশন নিয়ে ঘাটাঘাটি করতে গেলেই একটা বাদে অন্য সুপারপজিশনে ক্ষুদ্র কণার অস্তিত্ত্ব শেষ হয়ে যায়। তারমানে আমরা যখন সুপারপজিশন ব্যবহার করে হিসেব করতে যাব, দেখা যাবে Qubit “0 এবং 1” থেকে হয় 0 নয়তো 1 যেকোন একটা হয়ে যাবে, কোয়ান্টাম কম্পিউটার ভূলভাল উত্তর দেবে।
আনন্দের ব্যাপার হলো, সার্জ হারোস আর ডেভিড ওয়াইনল্যান্ড সুপারপজিশনগুলোকে ধ্বংস না করেই কোয়ান্টাম কম্পিউটারে মাপামাপি করার একটা উপায় বের করে ফেলেছেন, যা এই প্রযুক্তির ভবিষ্যৎ কে অনেকটা এগিয়ে নিয়ে গেছে। এই কাজটির জন্য তারা এই বছর পদার্থবিজ্ঞানে নোবেলও পেলেন। দেখা যাক, সামনে কি কি হয়।