একথা হয়ত এক বাক্যে স্বীকার করা যায় যে, ইউরোপের বৈজ্ঞানিক দর্শন আর বিজ্ঞান ভাবনার উপর ভরসা করে দাঁড়িয়ে আছে ‘আধুনিক বিজ্ঞান’ বলতে যা বোঝায় তার অনেক খানি। তবে সেই সাথে এটাও ভাবতে কি অবাক লাগে না যে, বিশ্বের মাত্র এক সপ্তমাংশ ভূখণ্ডেই কেন সকল বিজ্ঞান শাস্ত্রের শিকড় খুঁজে পাওয়া যাবে? আসলে খুব সম্ভবত এর পেছনে বিস্তারিত আছে ইউরোসেন্ট্রিজমের কালো ভুত, যা বহুযুগ ধরে ইউরোপের মানুষের রক্তের মাধ্যমে বয়ে আসছে। সেই রক্তের উত্তরাধিকার এমনকি বিংশ আর একবিংশ শতকের উন্নত মানসিকতার  ‘ ঐতিহাসিকদের মাঝেও খুব স্পষ্টভাবেই ফুটে ওঠে। আর সেই জন্যই চৈন বা ভারতীয় তো দূরে থাক, সভ্যতার মাতৃভূমি মেসোপটেমিয়ীয় কিংবা মিসরীয় জ্ঞান নিয়েও খুব একটা উচ্চবাচ্য শুনতে পাই না।

 

আমার অচিন্ত্য ক্ষুদ্র জ্ঞানের গণ্ডি নিয়ে আজকে লিখতে বসেছি প্রাচীন ভারতীয় গণিত নিয়ে, যার সূচনাকাল আজও অস্পষ্ট। আমার ধারণা, এই অস্পষ্টতার পেছনে দুই শ্রেণির মানুষেরই দায় আছে। এক শ্রেণি ‘অতিভারতীয়’, তাঁরা যে দর্শনে বিশ্বাসী তাতে এই ভারতীয় গণিত ( তথা বৃহৎ অর্থে বিজ্ঞান) আসলে কল্পনাতীত পুরাতন, যা বিশ্বের অন্যান্য অংশের সাথে তুলনা করলে অনেকাংশেই ধোপে টেকে না। [পাঠক, পুরো রচনায় ‘ভারত’ বলতে যা বোঝানো হবে তা পাকিস্তানের পশ্চিম সীমান্ত হতে বাংলাদেশসহ সমগ্র দক্ষিণপূর্ব এশিয়া নিয়ে বিস্তৃত] । আরেক শ্রেণি হল সেই ইউরোসেন্ট্রিক মানসিকতার মানুষ। তাঁদের দাবি খ্রিষ্টীয় ৫০০ সালের আগে এই ভারতবর্ষে কোন সত্যিকার গণিতজ্ঞ জন্মায় নি। অথচ আশ্চর্যজনক আর কারও কারও জন্য নিরাশাজনক হলেও সত্যি আজকের গাণিতিক বিদ্যার একটা বড় অংশের জন্ম হয়েছিল এই গঙ্গা-সিন্ধু-সরস্বতীর তীরেই।

 

আমার এই রচনাটি সাজানোর চেষ্টা করেছি খৃষ্টপূর্ব ৩০০০ সাল থেকে ১৬০০ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত ভারতবর্ষের গণিতের ইতিহাসের খানিকটা নিয়ে। পুরো রচনাটি তিনটি অধ্যায়ে বিভক্ত থাকবে। প্রথমটিতে প্রাচীন হরপ্পা সভ্যতা এবং তৎপরবর্তী বৈদিক, বৌদ্ধ ও জৈন গণিতবিদ্যা, দ্বিতীয়টিতে ৪০০ থেকে ১২০০ খ্রিস্টাব্দের মধ্যকার গণিতের ব্যপক প্রসার (ভারতীয় গণিতচর্চার স্বর্ণযুগ আখ্যায়িত), তৃতীয়টিতে ১২০০ থেকে ১৬০০ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে মুসলিম শাসনামলে গণিতচর্চা ও দক্ষিণ ভারতে গণিতের ব্যপক উত্থান ও অবশেষে ভারতবর্ষে গণিত যুগের নিশ্চুপ বিদায় নিয়ে আলোচিত হবে। পুরো রচনায় রেফারেন্স হিসাবে George Gheverghese Joseph রচিত ‘The Crest of the Peacock’, অমর্ত্য কুমার দত্ত রচিত ‘Methematics in Ancient Asia’ , উইকিপিডিয়া, গ্রহণ করেছি।

 

 

 

 

 

এক

 

হরপ্পার গল্প

 

 

ভারত বর্ষে গণিতের সূত্রপাত  ঠিক কবে ?

 

ভারতবর্ষে গণিতের সূত্রপাত কবে হয়েছিল তার সঠিক কোন উপাত্ত পাওয়া নিয়ে অস্পষ্টতার কথা আগেই উল্লেখ করেছি। তবে তা নিদেনপক্ষে পাঁচ হাজার বছরের পুরানো, এটুকু হলফ করে বলা যায়। ১৯২১ থেকে ১৯২৩ সালের মধ্যে একাধিক খনন কাজ শেষে সিন্ধু উপত্যকা, পাঞ্জাব, উত্তর প্রদেশ, রাজস্থান, গুজরাটসহ প্রায় বার লক্ষ বর্গ কিলোমিটার অঞ্চল নিয়ে এই প্রাচীন সভ্যতা আবিস্কার করা হয়। হরপ্পা, মহেন-জো-দারো, লোথাল এর মত বড় বড় শহর গুলি ছিল এই সভ্যতার প্রাণকেন্দ্র। পাঁচ হাজার বছর আগে এই শহর গুলো যে রকম পরিকল্পিতভাবে গড়ে উঠেছিল তার নিদর্শন দেখে আজও হতচকিত হয়ে যেতে হয়।

 

হরপ্পা সভ্যতার ধ্বংসাবশেষ থেকে প্রত্নতাত্ত্বিক অনুসন্ধান উদ্ধার হওয়া নিদর্শন থেকেই বিচার করি তাঁদের গণিত জ্ঞান কতখানি ছিল…

 

১. ওজনঃ প্রত্নতাত্ত্বিক খনন কাজ শেষে পাওয়া গিয়েছে প্রচুর পরিমাণ ওজন বাটখারা। ২৭.৫৮৪ গ্রামকে একক ধরলে এই বাটখারাগুলি ০.০৫, ০.১, ০.২,

চিত্রঃ হরপ্পা সভ্যতার বিভিন্ন অঞ্চল হতে আবিষ্কৃত ওজন (ছবিসূত্রঃ হরপ্পা ডট কম)

চিত্রঃ হরপ্পা সভ্যতার বিভিন্ন অঞ্চল হতে আবিষ্কৃত ওজন (ছবিসূত্রঃ হরপ্পা ডট কম)

০.৫, ২, ৫, ১০, ২০, ৫০, ১০০, ২০০, ৫০০ একক নির্দেশ করে। এটি ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ সাক্ষ্য কারণ তা তিন হাজার বছর পূর্বে ভারতবর্ষে ডেসিমাল সংখ্যা পদ্ধতি ব্যবহার এবং উন্নত ওজন পরিমাপ ব্যবস্থার অস্তিত্ব প্রমাণ করে। আমরা পরবর্তীতে দেখব, ভারতবর্ষে ডেসিমাল সংখ্যা পদ্ধতি ছাড়া অন্য কোন সংখ্যা পদ্ধতি কখনই প্রচলিত হয় নি।

 

 

২.মহেন-জো-দারো, হরপ্পা এবং লোথালে প্রত্নতাত্বিক অনুসন্ধানে উন্নত দৈর্ঘ্য মাপকাঠি আবিষ্কৃত হয়েছে। এগুলি দৈর্ঘ্যে ৬৬.২ মিলিমিটার। এতে ৬.৭০৫৬ মিলিমিটার সমান দুরত্বে নয়টি সমান্তরাল দাগ কাটা আছে। এগুলো এতই নিখুঁত যে গড়ে মাত্র ০.০৭৫ মিলিমিটার ত্রুটি পাওয়া গিয়েছে। পাঠক, মনে রাখতে হবে, আমরা কিন্তু এমন একটি সভ্যতার ব্যবহৃত গাণিতিক জ্ঞান নিয়ে গবেষণা করছি যাদের অস্তিত্ব ছিল আজ থেকে পাঁচ হাজার বছর আগে!

এই মাপকাঠিগুলোতে ছয় দাগ অন্তর একটা করে বৃত্ত চিহ্নিত করা আছে। দুটি বৃত্তের মধ্যকার দৈর্ঘ্য হল এক সিন্ধু ইঞ্চি( indus inch) । এই সিন্ধু ইঞ্চি আশ্চর্যজনকভাবে ‘সুমেরীয় শুশী (shushi)’ এর ঠিক দ্বিগুণ। প্রচ্ছন্নভাবে তা এই প্রাচীন দুই সভ্যতার কোন অভ্যন্তরীন যোগাযোগ ইঙ্গিত করে।

 

 

৩. এই প্রাচীন সভ্যতার এক বিশেষ উল্লেখযোগ্য দিক হল উনুনে পোড়ানো ইটের ব্যবহার। কৃষিকাজে উন্নত এই সভ্যতা বন্যা আক্রান্ত ফসলের

চিত্রঃ হরপ্পায় আবিষ্কৃত ইট… এইগুলিই বিশ্বের সর্বপ্রথম আধুনিক মাপের ইট!

চিত্রঃ হরপ্পায় আবিষ্কৃত ইট… এইগুলিই বিশ্বের সর্বপ্রথম আধুনিক মাপের ইট!

জমিতেও চাষাবাদ করতেন, এমনকি এই বন্যার পানিকে কিভাবে জমি তৈরির জন্য ব্যবহার করা যায় তা তাঁরা খুব ভালভাবেই শিখেছিলেন। তবে এর জন্য তাঁদের প্রথমে দরকার হল বন্যাকে নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষমতা। বাঁধ দেয়ার জন্য পাথর সব সময় পাওয়া যেত না, আর মাটির ঢেলা দিয়েও বন্যাকে আটকানো যেত না। তাই তাঁরা আবিস্কার করে ফেলল এক চমৎকার জিনিস- পোড়া ইট! পাঁচ হাজার বছরের পুরানো এই ইটগুলো কালের সাক্ষী হয়ে আজও বিদ্যমান। এগুলির মান এতই ভাল যে আজও তা ব্যবহার করা সম্ভব, শুধু সম্ভব বললে ভুল হবে, প্রাচীন এই ইট ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হয়েছে মুলতান টু লাহোর রেলওয়ে লাইনে! তবে বিভিন্ন স্থানে এরকম পনেরটি বিভিন্ন সাইজের ইট সনাক্ত করা গিয়েছে, তবে আশ্চর্যের ব্যাপার প্রত্যেকটা ইটের দৈর্ঘ্যঃপ্রস্থঃউচ্চতা ৪:২:১, তার চেয়েও আশ্চর্যের বিষয় আজ অব্দি এই অনুপাতটিকেই ইট তৈরির জন্য সব থেকে উপযোগী বিবেচিত হয় এবং আধুনিক সভ্যতার প্রত্যেকটি ইটই পাঁচ হাজার বছরের পুরানো এই ফর্মুলা মেনেই তৈরি হচ্ছে! 

 

হরপ্পায় ব্যবহৃত এইসব উন্নত ওজন ও দৈর্ঘ্য পরিমাপের যন্ত্র খ্রিস্টের জন্মের তিন হাজার বছর আগে ভারতবর্ষে জ্ঞানের গরিমা কেমন ছিল তার আভাস দেয়। তবে পরিতাপের বিষয় এই সভ্যতার আর তেমন কোন উল্লেখযোগ্য নিদর্শন অবশেষ নেই অথবা এখনও খুঁজে পাওয়া যায় নি। অবশ্য এখন পর্যন্ত মাত্র পাঁচ শতাংশ খননকাজ সম্পন্ন হয়েছে। ভবিষ্যতে হয়ত আমরা হরপ্পা সভ্যতার জ্ঞান কোন পর্যায়ের ছিল তা আরও অনেক ভালভাবে জানার সুযোগ পাব।

 

হরপ্পার স্থাপত্যের একটি বিশেষ দিক হল ইটের বহুল ব্যবহার। ছবিটি হরপ্পার একটি স্নানাগারের। ছবিসূত্রঃ হরপ্পা ডট কম

হরপ্পার স্থাপত্যের একটি বিশেষ দিক হল ইটের বহুল ব্যবহার। ছবিটি হরপ্পার একটি স্নানাগারের। ছবিসূত্রঃ হরপ্পা ডট কম

About the author

ঝেঁটুয়া

1 Comment

Leave a Comment