এক।
নরম পালকে ঢাকা পাখা আছে যার, সে-ই পাখিঃ সে উড়তে পারুক আর নাই পারুক। ঘন্টায় দুইশ’ মাইল বেগে উড়তে পারা পেরেগ্রাইন ফ্যালকন, কিংবা আদৌ উড়তে না পারা অস্ট্রিচ বা মেরুদেশের পেঙ্গুইন- সবারই কিন্তু ‘পাখি’ নামের একটা ট্যাগ লাগানো আছে। তবে আসলে এই পাখি কাদের বলা হয়?
আধুনিক সংজ্ঞা অনুসারে পাখি হল পালক আবৃত পাখাযুক্ত, দ্বিপদী, উষ্ণ রক্তের মেরুদণ্ডি প্রাণি। এরা ডিম পাড়ে, হজমক্ষমতা উচ্চ। এদের হৃদপিণ্ডের প্রকোষ্ঠ চারটি, কঙ্কাল খুবই শক্তপোক্ত!
দুই।
১৮৬১ সাল, জার্মানির সনহফেনে (Solnhofen) চুনাপাথরের খনিতে খনিকর্মীরা খুঁজে পেলেন সাদামাটা এক পালকের ফসিল। দেখতে যতই সাদামাটা
হোক, আদতে এসব জিনিসের মূল্য বোঝেন অল্প কিছু মানুষ। তাদেরই একজন ফসিলবিদ ক্রিশ্চিয়ান এরিখ হারম্যান ভন মেয়ার। চুনাপাথরের খনিতে পাওয়া ফসিল নিয়ে তিনি লেগে পড়লেন গবেষণায়, এক পর্যায়ে অবশ্য খানিকটা হতাশই হলেন, আশংকা- এটা আসল ফসিল তো? ইতোমধ্যে মেয়ার খুঁজে পেয়েছেন লেজ আর দাঁতওয়ালা কিন্তু পালকযুক্ত পূর্ণাঙ্গ কঙ্কালের ফসিল। পালকের গঠন আগেরটার মতই। সুতরাং আর কোন সন্দেহ নেই। বুঝতে পারলেন, একদম খাঁটি জিনিস নিয়ে গবেষণা করছেন তিনি- এ হল আজকের পাখিদের পূর্বসূরি ! মেয়ার এদের নাম দিলেন আদি-পক্ষী – Archaopteryx ( গ্রিক Archaios অর্থ আদিম, Ptryx অর্থ পাখা বা পালক)।
মেয়ারের এই আবিষ্কার সমসাময়িক ডারউইনবাদীদের দারুণ উজ্জীবিত করল। মাত্র দুই বছর আগে প্রকাশিত চার্লস ডারউইনের বিবর্তন তত্ত্ব সম্বলিত বই ‘On the Origin of Species by Means of Natural Selection’ তে ডারউইন দেখিয়েছেন, পূর্ব প্রজন্মের সদস্যরা তাদের উত্তরসূরীদের মধ্যে নিজেদের টিকে থাকার বিশেষ ক্ষমতা প্রদান করে যেতে পারে, ফলে, এক অর্থে, নতুন প্রজন্ম হয় আগের থেকেও খানিকটা উন্নত- প্রকৃতির নিজস্ব নির্ধারণেই; তারপর বহু বছর ধরে একটু একটু করে নতুন ক্ষমতার অধিকারী হয়ে এক সময় আপন প্রজাতি থেকেই অন্যরকম হয়ে পড়ে তারা; সৃষ্টি হয় নতুন প্রজাতি। ডারউইন নিজে সমুদ্র ভ্রমনে বেরিয়ে প্রচুর পরিমাণ প্রজাতির নমুনা বিশ্লেষণ করে এই মত দিয়েছিলেন। মেয়ারের আবিষ্কার ডারউইনের ধারণাকে আরও শক্তপোক্ত করল। দাঁত আর লেজওয়ালা পাখিদের থেকে বিবর্তিত হয়েছে আজকের পক্ষীকূল!
তিন।
মেয়ারের আবিষ্কারের পর আরও ফসিল আবিষ্কৃত হতে থাকে 150 মিলিয়ন বছরের পুরানো প্রজাতি আর্কিয়োপ্টেরিক্সের । আজ অব্দি এই সংখ্যা এগার। কিন্তু এই আদি পক্ষী কি সত্যিই আজকের পাখিদের আদি পিতা??
গত শতক ধরে এই প্রশ্নের ব্যাখ্যা নানাজন নানাভাবে দিয়েছেন। বিবর্তনবাদের বৈশিষ্ট্যই এই- প্রকৃতির নিজস্ব সূত্রে বিবর্তন চলতে থাকে, মানুষ কেবল গাঠনিক আর চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যগত মিল থেকে খুঁজতে থাকে কার আদিপুরুষ কে; তাই তো সব সময় সঠিক নির্ণয়ে পৌঁছানো সম্ভব হয় না, আজ যা সত্যি মনে হচ্ছে কাল হয়ত আরেক নতুন সত্য এসে তাকে ছাপিয়ে যাচ্ছে! এই যেমন, ভন মেয়ার কঙ্কালের সাথে পালক দেখেই এটাকে পাখিদের আদিপুরুষ হিসাবে আখ্যা দিয়েছিলেন। এটা কিন্তু মিথ্যা নয়। তবে পরবর্তী গবেষণাগুলি এর সাথে আরও নানা তথ্য উন্মোচন করেছে আর দেখিয়েছে আজকের শান্ত সুশীল পক্ষীকূলের সাথে অনেক বেশি যোগসূত্র আছে প্রাগঐতিহাসিক যুগের দানবীয় প্রাণি ডাইনোসরের, অর্থাৎ ডাইনোসর থেকেই এসেছে এই দাঁতাল পাখি, তারপর ধীরে ধীরে আজকের পাখি! ১৮৬৮ সালে এই তত্ত্ব প্রথম উত্থাপন করেন প্রভাবশালী জীববিজ্ঞানি T.H. Huxley। তিনি ঘোষণা করেন, মেয়ারের Archaeopteryx আসলে মাংসাশী ডাইনোসর থেকে আজকের পাখিদের বিবর্তনের মধ্যাবস্থা। তিনি Archaeopteryx কে তুলনা করলেন খুদে থেরোপড ডাইনোসরদের গণ Compsongnathus এর সাথে। এই থিওরি আজও সমধিক জনপ্রিয়। বরং আরও আধুনিক তত্ত্বগুলি অনেক ক্ষেত্রে পাখিদেরকেই ডাইনোসর হিসাবে আখ্যা দিয়েছে।
ডারউইনবাদী বিবর্তনের ধারণার প্রধান রসদ হল প্রজাতিগুলির অ্যানাটমিক্যাল সিমিলারিটি। সুতরাং এ দৃষ্টিকোন থেকে ডাইনোসর আর পাখিদের আত্মীয়তা বিচার করতে হলে আমাদেরকে চোখ দিতে হবে এদের শারীরিক বৈশিষ্টাদির উপর-
যখন পাখিঃ
পাখিদের মতই আর্কিওপ্টেরিক্স আকারে বেশ ছোট, বড়হয়ে এরা আধামিটার অব্দি হয় অর্থাৎ একটা বড়সড় দাঁড়কাকের সাইজের। তবে ডানা বেশ চওড়া।
পাখিদের মতই এদের আছে পালক এবং সেগুলি বেশ সুগঠিত। অনেকগুলো কার্ভযুক্ত এবং তিনটি সুস্পষ্ট শিরা দেখা যায়।
২০১৩ সালের এক গবেষনায় উদঘাটিত হয়েছে যে এই পালক ছিল সাদা কালো ছোপযুক্ত। পালকে কপারের উপস্থিতি কালচে ছোপের জন্য দায়ি। এই কপারের আছে ব্যাকটেরিয়া প্রতিরোধক গুণ, যা ১৫০ মিলিয়ন বছর ধরে ফসিলটিকে অক্ষত রেখেছে বলে ধারণা করা যায়। তবে আধুনিক পাখিদের মত পালক ততটা উন্নত না হওয়ায় এদের ওড়ার ক্ষমতা ছিল কি না তা আজও
পরিষ্কার নয়।
আর্কিওপ্টেরিক্সের পায়ের বুড়ো আঙ্গুল ফ্লেক্সিবল, অর্থাৎ নাড়াতে পারত। কিন্তু অন্যান্য ডাইনোসরদের মধ্যে এই বৈশিষ্ট্য দেখা যায় না, বরং পাখিদের মধ্যে দৃশ্যমান। আবার পাখিদের মতই এদের কন্ঠে উইশ বোন দেখা যায়। এদিকে সাম্প্রতিক গবেষনায় দেখা গেছে, আর্কিওপ্টেরিক্সের শ্রবণ ক্ষমতা বেশ নিম্নমানের ছিল, যা আজকের এমু জাতীয় পাখির সাথে তুলনীয়।
বিজ্ঞানিরা আর্কিওপ্টেরিক্সের ফসিলে পাওয়া কঙ্কালের অনুরূপ কাঠামো তৈরি করে তার উপর চামড়া-পালক লাগিয়ে শেষ অব্দি যেটা পেয়েছেন সেটাকে প্রথম দর্শনে কোন অদ্ভুত পাখি ছাড়া অন্য কিছু মনে হওয়াটা কঠিন।
যখন ডাইনোসরঃ
Archaeopteryx এর প্রতিডানার প্রান্তে তিনটি করে নখর দেখা যায়; আজকের পাখিদের ক্ষেত্রে এরকম অদ্ভুত কিছু দেখা যায় না। ধারণা করা হয় এরা এদের পাখাকে হাতের মত ব্যবহার করতে পারত, এমনকি পাখা দিয়া শিকার ধরার ক্ষমতা থাকাটাও অস্বাভাবিক না।
আরেকটা উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য হল লেজ। আর্কিওপ্টেরিক্সের কংকালকে পালকাবৃত করলে যতই একে পাখির মত দেখাক না কেন, সবার আগে যেটা নিয়ে দ্বিধান্বিত হতে হবে তা হল এই লেজ। কারণ আজকের কোন পাখির পশ্চাদদেশে অস্থিময় লেজ দেখা যায় না। দাঁড়কাকের পেছনে একটা পালক লাগানো লেজ লাগিয়ে একবার চিন্তা করে দেখুন তো কেমন লাগে !! ?
আর্কিওপ্টেরিক্সের শক্ত উদর বন্ধনী gastralia আছে। এটি কোন পাখির মধ্যে দেখা যায় না। বরং কুমির সহ সরীসৃপ ও ডাইনোকূলে বিদ্যমান। তাছাড়া এদের বক্ষাস্থী পাখিদের মত অতটা বাঁকা নয়, বেশ ডাইনোসরদের মত সমতল।
সম্প্রতি অ্যামেরিকান ন্যাশনাল মিউজিয়ামের গবেষকদল একটি গবেষনায় দেখিয়েছেন্Archaeopteryx এর দেহের তুলনায় মস্তিষ্কের অনুপাত ভয়ঙ্কর থেরোপড ডাইনোসর T. rexএবং আজকের পাখিদের মাঝামাঝি। আধুনিক পাখিদের ক্ষেত্রে দেহের তুলনায় মস্তিষ্কের অনুপাত অস্বাভাবিক রকম বেশি। কিন্তু Archaeopteryx এ অলফ্যাকটরি লোব ছাড়া আর কোন অংশে এত স্ফীতি দেখা যায় নি। মস্তিষ্কের এই সংকীর্ণতা বিজ্ঞানিদের ভাবাতে বাধ্য করে যে উড়বার মত প্রয়জনীয় বুদ্ধি এদের ছিল কি না !
Archaeopteryx এর অ্যানাটমির বিস্তারিত জানতে হলে এইটা দেখা যেতে পার…All about Archaeopteryx
মোদ্দা কথা, আর্কিওপ্টেরিক্সের শারীরিক গঠনে একই সাথে যেমন কিছু বৈশিষ্ট্য দেখা যায় যা কেবল পাখিদের মধ্যে দৃশ্যমান, তেমনি আরও কিছু বৈশিষ্ট্য দেখা যায় যা বিদ্যমান ভয়ংকর ডাইনোসর কূলে। এজন্য এরকম একটা বিবর্তনের চিত্র ধরে নেয়া যেতে পারে (ধরে নেয়া হয়ে থাকেও), ঠান্ডার হাত থেকে বাঁচার জন্য কিংবা বিপরীত লিঙ্গের কাছে নিজেকে আকর্ষণীয় করে তোলার জন্য ডাইনোকূলের ছোট প্রজাতিগুলির শরীরে পালক জন্মাতে থাকে; সেই পালক এক সময় পরিণত আকারের হয়; ঢেকে দেয় সামনের দুই হাত। তারপর একসময় দ্রুতগামী পালকাবৃত ডাইনোসরটি ডানা ঝাপটাতে ঝাপটাতে আবিষ্কার করে ফেলে যে তার পাখা ওড়ার জন্য এক চমৎকার অ্যারোডাইনামিক সাপোর্ট দেয়, অথবা গাছ থেকে লাফ দিতে দিতেই তা আবিষ্কার করে… সেই থেকেই প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে দুরন্ত চেষ্টার পরে আর্কিওপ্টেরিক্স হয়ে ওঠে দক্ষ ঊড়ুয়া !
চার।
পুনর্বারঃ আর্কিওপ্টেরিক্সই তাহলে আজকের পাখিদের পূর্বপুরুষ??
আসলে এর কোন উত্তরই হয় না। কারণ, প্রতিদিনই ফসিলবিদরা পৃথিবির নানাপ্রান্তে খুঁজে বেড়াচ্ছেন ডাইনোসরের ফসিল, যা ভীষনই আকাঙ্ক্ষিত বস্তু। ফলে আবিষ্কৃত হচ্ছে ডাইনোসরের নতুন নতুন প্রজাতি। তাই ১৮৬২ সালে আবিষ্কৃত একটা প্রজাতিকে একেবারে পাখিদের পূর্বপুরুষ ট্যাগ দেয়াটা পুরোপুরি বোকামি বৈ কিছু নয়। বরং শুদ্ধভাবে যদিArchaeopteryx কে কিছু ট্যাগ দিতে হয় তা হল, সর্বাধিক আলোচিত ক্ষুদ্র ডাইনোসরের ফসিল যা কিনা (হয়ত) ডাইনোসর থেকে পাখি প্রজাতি সৃষ্টির মধ্যবর্তী কোন এক দশা!!
তথ্যপঞ্জিঃ
১. David E. Fastovsky, and David B. Weishampel Dinosaurs – A Concise Natural History
২.Ross Piper- Extinct Animals: An Encyclopedia of Species that Have Disappeared during Human History
৩. All About Archaeopteryx – Chris Nedin
৪. NatGeo phenomena article: Archaeopteryx’s Evolutionary Humiliation Continues- Carl Zimmer
web: dinosaur.about.com
wikipedia.org