হেনরি পয়েনকেয়ার

গণিতবিদ হেনরি পয়েনকেয়ার

ফুটবলের সাথে একটা চারকোনা কিউবের যা মিল, সাইকেলের টায়ারের সাথে কফির মগের একই মিল। মিলটা কোথায়? ভাবতে থাকুন, কারন কিছুক্ষন পর এই বিশেষ মিলটাই আমাদের দরকার হবে।

অন্য কথায় আসা যাক। ধরি, কোন নির্দিষ্ট মাত্রায় (Dimension) একটা কেন্দ্রবিন্দু দেওয়া আছে, এ থেকে সমান দূরত্বে অবস্থানকারী বিন্দুগুলোর সেট বের করতে হবে। আরও ধরে নিই যে কেন্দ্র থেকে যে দূরত্বর কথা বলা হয়েছে তা হল ১ একক। একমাত্রিক জগতে আমরা কেন্দ্র ছাড়া ১ একক দূরত্বে মাত্র দুইটি বিন্দুই পাব, একে বলা হয় ০-গোলক। দ্বিমাত্রায় আমরা আবার কেন্দ্র থেকে এক একক দূরত্বে অনেকগুলো বিন্দু পাব, সেগুলোকে একসাথে নিলে নিঃসন্দেহে একটা বৃত্ত পাওয়া যায়। এর নাম হল ১-গোলক।

দেখা যাচ্ছে প্রথমবার পেলাম একটা বিন্দু, দ্বিতীয়বার একটা বৃত্ত, অথচ নাম দিয়ে
দেওয়া হল গোলক! কিন্তু তিন মাত্রার জগতে আমরা কিন্তু এই শর্তে একটা সত্যিকারের গোলকই পাব। টপোলজির ভাষায় একে বলে ২-গোলক, অথবা 2-Sphere।

এখানে আরেকটা কথা বলে রাখা উচিৎ। যে কারও মনে প্রশ্ন জাগতে পারে তিন মাত্রার জন্য আমরা যে গোলকটা পেলাম সেটাকে ৩গোলক না বলে ২গোলক বলা হয় কেন? অথবা ২ মাত্রার যে গোলক(সেটা আসলে বৃত্ত কিন্তু এই ক্ষেত্রে আমরা গোলকই বলি) পাওয়া গেল তাকে ১গোলকই বলে কেন? তার কারন হলো, আমরা টপোলজি নিয়ে কথা বলছি। টপোলজি কোন বস্তুর পৃষ্ঠ বা সারফেস নিয়ে আলোচনা করে। এখানে গোলক বলতে কেবল গোলকের বাইরের অংশটাকেই বুঝানো হয়েছে, ভেতরে কি আছে তা নিয়ে আমাদের মাথাব্যাথা না করলেও চলবে। আমাদের পৃথিবীকে একটা ত্রিমাত্রিক গোলক কল্পনা করলে বুঝা যাবে উপরের পৃষ্ঠ আসলে দ্বিমাত্রিক, তাই পৃথিবী হল ২গোলক। তেমন একটা ১গোলকের বা বৃত্তের পরিধি একমাত্রিক, শুধু একটা বক্ররেখা।

এখন মনে করুন আপনার কাছে একটা চারকোনা কিউব দেওয়া হল, আরও ভাল ভাবে বললে কিউবের সারফেসটা দেওয়া হল যেহেতু আমরা টপোলজি নিয়ে কথা বলছি। কিউবটা এমন কোন পদার্থ দিয়ে তৈরি যাকে যেমন খুশি তেমন টেনে লম্বা করা যায়, চাপ দিয়ে ছোট করা যায়, যেমন খুশি পরিবর্তন করা যায়। এখন ইচ্ছা করলেই মুচড়ে-টুচড়ে আপনি চট করে কিউবটাকে একটা ২গোলক বানিয়ে ফেলতে পারবেন। কিন্তু শর্ত হল, কাঠামোটাকে ভাঙ্গা যাবে না, কোন ছিদ্র করা যাবে না, ঘুরিয়ে এনে এক অংশ অন্য অংশের সাথে যুক্ত করা যাবে না। অর্থাৎ একটু চিন্তা করলেই বুঝা যাবে এই শর্তে কিউবটাকে মুচড়ে টুচড়ে একটা ফুটবল বানানো গেলেও কখনও সাইকেলের টায়ারে পরিবর্তন করা যাবে না।

আমাদের এই কিউবের পৃষ্ঠটার একটা নাম আছে, মেনিফোল্ড(Menifold)। আসলে যে কোন ধরনের পৃষ্ঠকেই একটা মেনিফোল্ড বলা যায়। যে কাগজের উপর আমরা তা একটা মেনিফোল্ড, টায়ারের বাইরের পৃষ্ঠ একটা মেনিফোল্ড, বৃত্তের পরিধি একটা মেনিফোল্ড, আমাদের ২গোলকও একটা মেনিফোল্ড। তলের সাথে মেনিফোল্ডেকে চিন্তা করা যেতে পারে। মেনিফোল্ড মোটেও কঠিন কোন ধারনা নয়, আমার ধারনা যারা আগে জানতো না তারা ইতিমধ্যেই বুঝে ফেলেছে।

এখন, যেহেতু টপোলজি সারফেস নিয়ে কাজ করে আর একটা কিউবের সারফেসকে পরিবর্তন করে ২গোলকে রূপান্তরিত করা যায়, তাই টপোলজিতে কিউবও একটা ২গোলক! আরও সুন্দর আর শুদ্ধ করে বলতে গেলে কিউব আর গোলক সদৃশ। কিন্তু তাহলে সাইকেলের টায়ারের সাথে মগের মিলটা কোথায়? সাইকেলের টায়ারে খুব বড় একটা ছিদ্র আছে, তেমন কফির মগের হাতলটা যেখানে যুক্ত থাকে সেখানে একটা ছিদ্র তৈরি হয়, যেমন আছে আংটিতে, আবার আছে চুড়িতে। এই একটি ছিদ্রের কারনে এরা গোলকের সদৃশ নয়, কিন্তু একে অপরের সদৃশ। এমন ধরনের আকৃতিকে বলা হয় টোরাস (Torus)। যেহেতু এদের একটা ছিদ্র তাই এদের genus 1। কিউবের genus ০। যে চিহ্ন দিয়ে অসীম বুঝানো হয় তার genus 2। মেনিফোল্ডের সাথে মেনিফোল্ডের এই সাদৃশ্যের একটা গালভরা টার্ম আছে, বলা হয় এরা হোমিওমরফিক (Homeomorphic)।

গোলকের খুব একটা মজার বৈশিষ্ট আছে। ধরা যাক কোন একটা গোলকের সাথে একটা রাবার ব্যান্ড পেচানো আছে। রাবার ব্যান্ডটা খুব স্পেশাল, একে যত খুশি তত বড়-ছোট করা যায়, ইচ্ছা করলে ছোট করতে করতে একটা বিন্দুতে নিয়ে আসা যায়। এখন রাবার ব্যান্ডটাকে গোলকের পৃষ্ঠ ঘেষে নিচে নামাতে থাকলে একসময় তা বিন্দুতে পরিণত হবে! টোরাসের ক্ষেত্রে কিন্তু এমনটা ঘটে না, চিন্তা করে দেখুন। এই বৈশিষ্টের জন্য গোলক অর্থাৎ যেকোন genus 0 ২গোলককে বলে Simply Connected (বাংলা কি হবে, সাধারনভাবে যুক্ত? পরিভাষা নিয়ে ভাল ঝামেলা হচ্ছে। কোন টার্মের যে বাংলা আছে আর কোনটার নাই তাই বলতে পারি না। মুটামুটি ভাবে তাই আসল ইংরেজী শব্দগুলোই দিয়ে দেওয়া হল)।

আমরা ২গোলককে দেখলাম, কিন্তু ৩গোলক কেমন জিনিস হতে পারে? যতটুকু ধারনা করা যাচ্ছে এটা একটা ত্রিমাত্রিক পৃষ্ঠ, অথবা বলা যায় একটা চতুর্মাত্রিক গোলকের পৃষ্ঠ। কিন্তু ত্রিমাত্রিক পৃষ্ঠটা কেমন হয় বা চতুর্মাত্রিক গোলকটা কেমন হয়? দুঃখজনক ভাবে এমন গোলক আমাদের পক্ষে দেখা সম্ভব নয়, কল্পনা করাও মোটেও সহজ নয়। তবে চেষ্টা করলে একটা ধারনা আনা যেতে পারে। আমরা ৩গোলককে নিয়ে গাণিতিক হিসাব নিকাশ করতে পারি, কিন্তু দেখতে পারি না। ৩গোলককে, যার অপর নাম হাইপারস্ফিয়ার (Hypersphere) ব্যাখ্যা করতে গেলে আরেকটা ঝামেলার সৃষ্টি হবে, তবে ইন্টারনেটে ঘাটাঘাটি করলে কিছু ভাল সাইট পাওয়া যাবে।

শিরোনাম পয়েনকেয়ারের অনুমান, কিন্তু পয়েনকেয়ার কই গেল? এখন পয়েনকেয়ার আসছে। ১৯০৪ সালে ফ্রান্সের গণিতবিদ হেনরি পয়েনকেয়ার একটা অনুমান করেন, অনুমানটা হল “প্রতিটা Compact(আপাতত সসীম বলা যেতে পারে। একটা বৃত্ত বা গোলক Compact, কিন্তু কোন অসীম রেখা বা সম্পূর্ণ একটা অসীম তল Compact নয়) এবং Simply Connected ৩ মেনিফোল্ড একটা ৩ গোলকের সাথে “Homeomorphic”। আগেই বলেছি যেকোন ২ মেনিফোল্ড আর ২ গোলক হোমিওমরফিক। পয়েনকেয়ারের এই অনুমান, যার আসল নাম হলো Poincare’s conjecture, বলে যে ৩গোলকের জন্য মানে চার মাত্রার জগতেও ঠিক এমনটিই হবে।

Poincare’s conjecture গণিতবিদদের ব্যাপক ভুগিয়েছে সত্যিই, কিন্তু এ নিয়ে খুব মজার মজার ঘটনা ঘটতে লাগল। নিজের কনজেকচার এর প্রথম প্রমাণটা দিলেন পয়েনকেয়ার নিজেই, কিন্তু কয়দিন যেতে না যেতেই তিনি নিজেই এটাতে ভুল বের করে ফেললেন। এরপর একটা প্রমাণ দিলেন হোয়াইটহেড, কয়দিন যেতে না যেতেই তিনিও নিজের প্রমাণে ভুল বের করে ফেললেন। এরপর অনেক গবেষণা হলো, গণিতবিদরা ৩ মাত্রার উপরের সবগুলো মাত্রার মে

গ্রিগরি পেরেলমান

গ্রিগরি পেরেলমান পয়েনকেয়ারের অনুমান প্রমাণ করেও পুরস্কার গ্রহন করেননি

নিফোল্ডের জন্য দেখালেন এমনই হবে, বাকি রইল পয়েনকেয়ারের মূল সমস্যাটাই। ২০০০ সালে Clay Mathematics Instititute পয়েনকেয়ার কনজেকচারকে সাতটা মিলেনিয়াম প্রাইজ প্রবলেমের অন্তর্ভূক্ত করে দিল, যার একটা প্রমাণ করলেই পাওয়া যাবে ১ মিলিয়ন ডলার, এবং কিছুদিন যেতে না যেতেই ২০০২-২০০৩ সালে গ্রিগরি পেরেলমান এটা প্রমাণ করে ফেললেন।

পেরেলমান সম্পর্কে একটু বলা দরকার। এই রাশিয়ান গণিতবিদ কনজেকচারটা প্রমাণ করে খুব বড় কাজ করেছেন ঠিকই, কিন্তু তার থেকেও অদ্ভুত এবং বড় কাজটা করলেন তা হল – ১ মিলিয়ন ডলার, প্রায় ৭০-৮০ কোটি টাকা দামের পুরষ্কার, সাথে গণিতের নোবেল খ্যাত ফিল্ডস মেডেল, দুটোই তিনি অস্বীকার করলেন! তার ধারনা কনজেকচারের সমাধানে তার যতটা অবদান তার থেকে কম অবদান নয় কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের রিচার্ড হ্যামিল্টনের, যাকে পুরষ্কার না দেওয়াটা অন্যায় হয়েছে।

তথ্যসূত্র :
1. প্রাণের মাঝে গণিত বাজে – সৌমিত্র চক্রবর্তী
2. http://en.wikipedia.org/wiki/Poincaŕe_conjecture
3. http://www.claymath.org/millenium/Poincare_Conjecture/
4. http://mathworld.wolfram.com/PoincareConjecture.html
5. http://www.mathematics-in-europe.eu/index.php?option=comcontent&view=article&id=114&Itemid=18&lang=en

রিভিউ:
Sending
User Review
5 (2 votes)

About the author

মৃন্ময় আকাশ

আপাতদৃষ্টিতে অযৌক্তিক পৃথিবীর যুক্তি অন্বেষনে।

Leave a Comment